বাংলাদেশ রূপবৈচিত্র্যের দেশ। এদেশে অতীতকাল থেকেই হাজারধরনের সংস্কৃতি পালন করা হয়। যার একটি অন্যন্য নিদর্শন হল, মৃৎশিল্প। মৃৎ মানে মাটি, আর শিল্প মানে সুন্দর সৃষ্টিশীল বস্তু। তাই মাটি দিয়ে নিজ হাতে তৈরি শিল্পকর্মকে মৃৎশিল্প বলে। এই শিল্পটি হল বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও অন্যতম একটি শিল্প। মাটি দিয়ে তৈরি এই শিল্প কর্মের মধ্যে রয়েছে মাটির কলস, হাড়ি, সরা, বাসন, কোসন, পেয়ালা, সরাই মটকা, শালা, পিঠে তৈরির ছাচ ইত্যাদি। এই শিল্পের প্রধান উপকরণ হলো মাটি। আর এই শিল্পের প্রধান শিল্পী হলো আমাদের কুমোর সম্প্রদায়। কুমোর সম্প্রদায়ের হাতের নৈপুণ্য ও কারিগরি জ্ঞানে মাটি দিয়ে তৈরি শিল্প কর্মকে মাটির শিল্প বা মৃৎশিল্প বলা হয়।
ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, মাটির শিল্প প্রথম চীনের বিখ্যাত শহর থাংশানে প্রচলিত ছিল। এই ইতিহাসকে চিরজীবিত করে রাখতে এ শহরটিকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়। চীনের রাজধানী বেইজিং থেকে ১৫০ কি.মি. উত্তর- পূর্বের এই শহরের পথে-প্রান্তরে, বিনোদন কেন্দ্র বা পার্ক গুলোতে মৃৎ শিল্পের বিভিন্ন শিল্পকর্ম দেখতে পাওয়া যায়। মিং রাজবংশের ইয়ুং লে এর সময়কালে থাংশানের মৃৎশিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশের সূত্রপাত হয়। বর্তমানে সেখানে নানানধরনের চীনা মাটির ৫০০টিরও বেশি মৃৎশিল্প দেখা যায়। চীনে মাটির তৈরি তৈজসপত্র ও শো-পিসকে বলা হতো ‘সেলাডন’। সেলাডন প্রস্তুতির পর পুরো চীন দেশজুড়ে, আর আশেপাশের বিভিন্ন দেশেও ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। ফলে চীনারা এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় সেলাডন রপ্তানি শুরু করে।
আমাদের দেশেও আদি আমল থেকে মৃৎ শিল্পের চলন চলে আসছে। পোড়া মাটির নানাবিধি কাজ, গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্ দ্রব্যাদি, পুতুল, খেলনা, প্রতিমা, প্রতিকৃতি, টপ, শোপিসসহ অসংখ্য জিনিস আজও কুমারশালায় তৈরি হয়ে। আর ক্রেতাদের কাছে এখনও এর চাহিদা অনেক। একসময় কাউকে মাটির তৈরি হাঁড়ি কিংবা গণেশের মূর্তি দিলে বিনিময়ে ওই পাত্রে বা মূর্তির পেটে যত চাল ধরে তত চাল দেওয়া হতো শিল্পীকে। মাটির তৈরি বিভিন্ন রকমারি আসবাবপত্র চেয়ার, টেবিল ইত্যাদির চাহিদা এখনও লক্ষ্যনীয়। প্রাচীনকাল থেকেই মৃৎশিল্প বিভিন্ন সভ্যতায় অনেক মর্যাদা লাভ করেছে। বাংলাদেশের জাতীয় ঐতিহ্য ও গৌরবের নিদর্শন এই মৃৎ শিল্প। অতীতে যখন কাঁচ, সিরামিক, মেলামাইন, অ্যালুমনিয়ামের প্রচলন ছিল না, তখন মানুষ মাটির তৈরি জিনিসপত্রই ব্যবহার করত। হাঁড়ি-পাতিল, ডাবর-মটকি থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় সব কিছু, যেমন মাটির ব্যাংক, শোপিস, গহনা, কলস, ফুলের টব, ফুলদানি, ঢাকনা, পিঠা তৈরির ছাঁচসহ নানা রকম খেলনা তৈরি করেন মৃৎ শিল্পীরা।
বাংলাদেশের প্রাচীন শিল্পকলার পরিচয় পাওয়া যায় মাটির শিল্পে। এটা এ দেশের নিজস্ব শিল্প। বৈশাখী মেলায় নানা পার্বনে যেসব মাটির জিনিস বিক্রি হয় সেসব কিছুই মাটির শিল্প। গ্রামের কুমোরেরা নিপুণভাবে এসব তৈরি করে। প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশে মৃৎশিল্প বা মাটির শিল্পের চর্চা হয়ে আসছে। তাই মৃৎ শিল্প হল আমাদের দেশের সবচেয়ে প্রাচীন শিল্প। হাঁড়ি কলসি ছাড়াও আমাদের দেশে এক সময় গড়ে উঠেছিল সুন্দর পোড়ামাটির ফলকের কাজ, যার নাম টেরাকোটা। নকশা করা মাটির ফলক ইটের মত পুড়িয়ে তৈরি করা হত, এই টেরাকোটা। ময়নামতির শালবন বিহার, বগুড়ার মহাস্থানগড় ও বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদে যেসব পোড়ামাটির ফলকের নিদর্শন রয়েছে সেসবই এই প্রাচীন শিল্পের উদাহরন। সম্প্রতি নরসিংদীর ওয়ারী বটেশ্বরে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে নানা ধরনের সুন্দর মাটির পাত্র আর ফলক। তাই মাটির শিল্প আমাদের ঐতিহ্য ও গৌরবের বিষয়।
যদিও আধুনিকতার ভিড়ে মৃৎশিল্প বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি প্লাষ্টিক, অ্যলোমিনিয়াম, মেলামাইন ও স্টিলের জিনিসপত্র তৈরী হওয়ায় এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজারে টিকতে পারছিল না মৃৎশিল্পের আসবাবপত্র। এ ব্যবসায় মন্দাভাব থাকায় এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা দুর্দিনের দুঃস্বপ্ন দেখছিলেন। এছাড়াও, পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বাজারজাতকরণে ত্রুটি ও পরিবহন সমস্যায় জর্জরিত মৃৎশিল্প। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়ে কৃষি, মৎস্য চাষ, রিক্সা, ভ্যান নির্মান ও চালানোসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন। কিন্তু এখন কুমার শিল্প আবার যেন তাঁদের নিখুঁত কাজের মাধ্যম নিয়ে ফিরে আসছে আমাদের মাঝে। দেশ ছেড়ে বিদেশেও এখন ছড়িয়ে পড়ছে কুমারদের হাতে তৈরি দৃষ্টি নন্দিত এসকল জিনিস। ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকার সাভার, কুমিল্লা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কুমারদের তৈরি জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানীর শাহবাগ, কলাবাগান, মালিবাগ, উত্তরার ফুটপাতসহ সারাদেশের বড় বড় শপিং কমপ্লেক্সেও এখন শোভা পাচ্ছে এই মৃৎশিল্প।
মৃৎশিল্পের উন্নয়নের খাতিরে সরকার এবং বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাগুলো বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারে। ভবিষ্যতে যেন এই শিল্প আর ধ্বংসের পথে ধাবিত না হয়, তাই সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। প্রত্যেক জেলায় জেলায় মৃৎ শিল্পের বাজার তৈরি করতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা গ্রহন করে এর ব্যবহার সম্পর্কে উৎসাহিত করতে হবে। বর্তমানে মানুষ শৌখিনতার জন্য মাটির তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহারের চাহিদা দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখন নিত্যনতুন ডিজাইনের মাটির জিনিস বাজারে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে যা আমাদের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। তাই মৃৎশিল্প বিকাশে বিকাশে আরও সচেতনতা গ্রহন করতে হবে।
Discussion about this post