ইমতিয়াজ আহমেদ
আজকের পৃথিবীর অন্যতম এক রোগের নাম ডায়াবেটিস। এতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অ-নিরাময়যোগ্য এই রোগের চিকিৎসা নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন। সারা বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বৃহৎ হাসপাতাল আমাদের বাংলাদেশের বারডেম। শাহবাগে অবস্থিত ছয় শত শয্যার এই হাসপাতাল এক মহান মানুষের স্বপ্নের ফসল। তিনি জাতীয় অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ ইব্রাহিম।
জন্ম ও শিক্ষা
৩১ ডিসেম্বর ১৯১১ সালে ডক্টর ইব্রাহিমের জন্ম হয়। তার পরিবার বাস করত বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের অন্তর্গত ভারতপুরের এক ছোট গ্রাম খারেরাতে। তার বাবা ছিলেন গ্রামের পোস্টমাস্টার। গ্রামের স্কুলেই তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। বেশ কয়েক মাইল হেঁটে তিনি নিয়মিত স্কুলে উপস্থিত হতেন। তার বাবা পড়ালেখা চালিয়ে যেতে তাকে উৎসাহ দেন। বাবার উৎসাহে তিনি কষ্ট করে একটি বৃত্তি জোগাড় করে ফেলেন। সেকালে মুসলিম ছাত্রদের জন্য বৃত্তি খুব দুর্লভ ছিল।
মুর্শিদাবাদের এডওয়ার্ড উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ডক্টর ইব্রাহিম ম্যাট্রিকুলেশন (এখনকার এসএসসি) পাশ করলেন। ইন্টারমিডিয়েট তিনি পাশ করেন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে। এই কলেজের বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ। এরপর ১৯৩৮ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে লাভ করেন এমবিবিএস ডিগ্রি। এখানেই তিনি চিকিৎসক হিসেবে প্রায় সাত বছর কাজ করেন। দেশভাগের পর তিনি বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) চলে আসেন।
বাংলাদেশে আসার পর ডক্টর ইব্রাহিম চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন নিযুক্ত হন। সেই সাথে তিনি এখানকার হাসপাতালের দেখাশোনা করতেন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে মেডিসিন বিভাগে তিনি শিক্ষকের কাজেও যোগ দেন। এখান থেকেই ১৯৪৮ সালে ডক্টর ইব্রাহিম লন্ডনে গমন করেন উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে। পরের বছরই তিনি রাজকীয় চিকিৎসক কলেজ থেকে এমআরসিপি ডিগ্রি লাভ করলেন। ১৯৫০ সালে আমেরিকান বক্ষব্যাধি চিকিৎসকদের কলেজ থেকে তাকে এফসিসিপি প্রদান করা হয়।
কর্মজীবন
১৯৫০ সালেই ডক্টর ইব্রাহিম দেশে ফিরে আসেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে চারিদিক তখন টালমাটাল। এর মধ্যেই তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে যোগ দেন। পরে তাকে মেডিসিনের অধ্যাপক নিযুক্ত করা হয়। তার মেধা আর প্রজ্ঞায় তিনি চিকিৎসা গবেষণা কাউন্সিল আর পাকিস্তানের বিজ্ঞান গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের পদেও উন্নীত হন।
ডায়াবেটিস রোগ নিয়ে ডক্টর ইব্রাহিম প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন। তিনিই প্রথম অনুধাবন করলেন যে দীর্ঘমেয়াদী এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে সাফল্য পেতে হলে চিকিৎসকের পাশাপাশি রোগীকেও চিকিৎসা বিষয়ক সিদ্ধান্তে যতটা সম্ভব অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ রকম চিন্তা মাথায় নিয়ে সমমনা আরো কিছু মানুষ তার সঙ্গী হয়। ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় তার নেতৃত্বে গঠিত হয় ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অফ পাকিস্তান, যা স্বাধীনতার পরে পরিবর্তিত হল বাংলাদেশে ডায়াবেটিক সমিতিতে। ১৯৬৪ সালে করাচি আর লাহোরেও অ্যাসোসিয়েশন স্থাপিত হল।
এদিকে ১৯৫৭ সালে ডক্টর ইব্রাহিম সেগুন বাগিচায় ৩৮০ স্কয়ার ফিটের এক টিনের দালানে ২৩ জন ডায়াবেটিক রোগী নিয়ে বহির্বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে সেবা দিতে থাকেন। এখানে রোগী ভর্তির কোনো ব্যবস্থা না থাকায় জটিল রোগীদের অন্যান্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে হত। পরে ১৯৭০ সালে কয়েকটি বিছানা এখানে যুক্ত করে কিছু রোগী রাখার ব্যবস্থা করা হল। তার কাজের মূলমন্ত্র ছিল কোনো ডায়াবেটিক রোগী, তার সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থা যা-ই হোক না কেন, বিনা চিকিৎসায় যেন মারা না যায়। তিনি কোনো টাকা ছাড়াই ডায়াবেটিক রোগীদের সেবা দিতেন, তাদের অবস্থার উন্নতিতে রাতদিন নিরলস পরিশ্রম করতেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৮০সালে ডক্টর ইব্রাহিম ঢাকা শহরের শাহবাগে প্রতিষ্ঠা করলেন বার্ডেমের। সেগুন বাগিচার হাসপাতাল এখানে সরিয়ে আনা হল। সারা এশিয়াতে এইটিই সর্বপ্রথম ডায়াবেটিসের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল। এখানে চিকিৎসকদের ডায়াবেটিস বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি একটি বিভাগও স্থাপন করেন, যাতে ডায়াবেটিস রোগীদের আধুনিক চিকিৎসার জন্য দক্ষ জনবল তৈরি হয়। ১৯৮২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বার্ডেমকে সহযোগী সংস্থা হিসেবে ঘোষণা করে।
ডক্টর ইব্রাহিম বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টিবিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়াও তিনি ঢাকার জুরাইনে তৈরি করেছিলেন পুনর্বাসন ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। তার ইচ্ছা ছিল এগুলোর মাধ্যমে তিনি ডায়াবেটিস রোগীদের স্বল্প মূল্যে পুষ্টিকর খাদ্য আর দরিদ্রদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে পারবেন। তিনি বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সংস্থারও একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ১৯৭০ সালে তিনি স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়। বলা যায় তার নিরন্তর চেষ্টার ফলেই জনসংখ্যা বিষয়ক নীতিমালা তৈরি ও গৃহীত হয়। তার পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় জনসংখ্যা কাউন্সিল যাত্রা শুরু করে।
বয়স্ক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়েও ডক্টর ইব্রাহিম সোচ্চার ছিলেন। বাংলাদেশ জেরিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু করে প্রায় বার বছরের মতো দায়িত্ব পালন করেন। বয়স্কদের নিয়ে কাজের সুবাদে লন্ডনে তিনি আন্তর্জাতিক বয়স্ক ফেডারেশনের কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৬-৮৮ সাল অবধি তিনি সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সংস্থারও চেয়ারম্যান ছিলেন।
স্বীকৃতি
চিকিৎসাক্ষেত্রে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদা দেয়। চিকিৎসকদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন। এছাড়াও তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু পদক পেয়েছেন। ১৯৭৯ সালে তিনি স্বাধীনতা পদক, ১৯৮১ সালে জনকল্যাণ আর চিকিৎসা ও সমাজ উন্নতিতে অবদানের জন্য বেগম জেবুন্নেসা আর কাজি মাহবুবুল্লাহ ট্রাস্টের তরফ থেকে স্বর্ণপদক, চিকিৎসা ও সামাজিক ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকার জন্যে ১৯৮৫ সালে মাহবুব আলি খান ট্রাস্টের স্বর্ণপদক আর ১৯৮৬ সালে কুমিল্লা ফাউন্ডেশনের থেকে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৮৯ সালে আহসানুল্লাহ মিশন ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশও তাকে সম্মান প্রদান করে। ডক্টর ইব্রাহিম জর্ডানের আম্মানে ইসলামিক অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস এরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
মৃত্যু
১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখে ডক্টর মোহাম্মদ ইব্রাহিম মৃত্যুবরণ করেন। তার সম্মানে শাহবাগে প্রতিষ্ঠিত ডায়াবেটিক হাসপাতালের নামকরণ করা হয় ইব্রাহিম মেমোরিয়াল ডায়াবেটিস সেন্টার। এখানে এখন একটি মেডিক্যাল কলেজও চালু হয়েছে। প্রতিবছর তার মৃত্যু দিন সেবা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
বাংলাদেশে এখন ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। লাখ লাখ মানুষ বিশেষায়িত হাসপাতাল থেকে সেবা পাচ্ছে। দেশের আনাচে কানাচেও ডায়াবেটিসে চিকিৎসার কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। ডায়াবেটিস নিয়ে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন কার্যক্রম গতিশীল রয়েছে। প্রতিবছর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসও পালিত হচ্ছে। এ সমস্ত কিছুই সম্ভব হয়েছে একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানব দরদী চিকিৎসকের জন্য, যার নাম ডক্টর মোহাম্মদ ইব্রাহিম।
This is a Bengali language article about Dr. Muhammad Ibrahim, the visionary physician who pioneered Diabetes management in Bangladesh with the establishment of Diabetic Associations and BIRDEM.
References
- BIRDEM Hospital https://uralems.com/birdem-hospital/
- Mohammad Ibrahim (2017) Early lif: http://www.londoni.co/index.php/61-history-of-bangladesh/biography/dr-mohammad-ibrahim/359-dr-mohammad-ibrahim-early-life-family-life-education-family-planning-association-of-bangladesh-fpab-biography-of-muslim-and-bengali
- Ibrahim, Mohammad: http://en.banglapedia.org/index.php?title=Ibrahim,_Mohammad
- Mazid M A (2015) National Professor Dr Muhammad Ibrahim: A pioneer in diabetic care in Bangladesh: http://www.theindependentbd.com/arcprint/details/14562/2015-09-06
- Prof Dr Ibrahim, a life devoted to diabetic care http://www.ourtimebd.com/beta/2018/09/07/prof-dr-ibrahim-a-life-devoted-to-diabetic-care/
Featured Image Source: ccvd.ibrahimcardiac.org.bd
Discussion about this post