অনলাইন ডেস্ক
‘বেগম মুশতারী শফী এমন একটা নাম; যিনি জন্মের পর থেকেই সংগ্রাম ও যুদ্ধ করেছেন। মাত্র তিন মাস বয়সে তিনি তার মাকে হারিয়ে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। এরপর কিছু বুঝতে শিখতে না শিখতেই সাত বছর বয়সে বাবা হারিয়েছেন। সব সামলে সংসার শুরু করলেও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছেন স্বামীকেও।’ মায়ের শেষ শ্রদ্ধা আয়োজনে অংশ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বেগম মুশতারী শফীর ছেলে মেহরাজ তাহসিন শফী।
বরেণ্য সাহিত্যিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, নারীনেত্রী ও শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফীকে শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। মঙ্গলবার (২১ ডিসেম্বর) সকাল সোয়া ১১টায় শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ শহীদ মিনারে আনা হয়। এসময় বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরাসহ সর্বস্তরের মানুষ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
এসময় মেহরাজ তাহসিন শফী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র রাখতে গিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। আমরা বাবার আদর-স্নেহ পাইনি, মাকেই আমরা একইসঙ্গে বাবা এবং মা হিসেবে পেয়েছি। বাবা ও মায়ের দায়িত্ব পালন করে তিনি আমাদের সাত সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।’
এসময় পরিবারের আক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন তিনি। বলেন, ‘আমাদের আশা ছিল তিনি স্বাধীনতা পদক পাবেন। কিন্তু আমরা এখনও জানি না তিনি আর পাবেন কিনা!’
ফুলেল নিবেদন করে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম- মুক্তিযুদ্ধ’৭১ কেন্দ্রীয় কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, উদীচী, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বাসদ মার্কসবাদীর পক্ষে বজলুর রশীদ ফিরোজ, গণতন্ত্রী পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটি, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, নরসিংদী সাকির পাড়া কে কে ইনস্টিটিউট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নরসিংদী জেলা প্রশাসন, নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগ, নরসিংদী উপজেলা পরিষদের পক্ষে উপজেলা চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দীন ভূইয়া, বাংলাদেশ তাঁতীলীগ, হাজীগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ, নোটারি ক্লাব, নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগ, নরসিংদী জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, গাজীপুর ইউনিয়ন যুবলীগ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সমাজতাত্ত্বিক ছাত্র ফ্রন্ট, যুব ইউনিয়ন, সাংস্কৃতিক সংগঠন চেতনা, বটতলা, গেরিলা ১৯৭১, গীতাঞ্জলি, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, নাট্যযোদ্ধা, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠী, রক্তধারা’৭১, গৌরব’৭১, সুবাচণ নাট্য সংসদ, ভিন্ন ধারাসহ সর্বস্তরের মানুষ।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে তার অসাধারণ ভুমিকা ছিল এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে একজন শব্দ সৈনিক হিসেবে তিনি যে অসাধারণ ভুমিকা রেখেছেন; জাতি তা কৃতজ্ঞতা সাথে চিরকাল স্মরণ করবে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যখন আমরা একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছি বেগম মুশতারী শফী ছিলেন আমাদের অনুপ্রেরণা। চট্টগ্রামে তিনি আন্দোলন সংগঠিত করেন এবং ১৯৯৪ সালে যখন গোলাম আজমের সমাবেশ তার নেতৃত্বে প্রতিহত করা হয়। সেই আন্দোলনের নেত্রীকে আমরা হারিয়েছি। আজকে আমরা দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শহীদ মিনারে সমবেত হয়েছি। তিনি যে লিগেছি রেখেছে গেছেন, যে উত্তরাধিকার রেখে গেছেন তা আমাদের তরুণ কর্মীদের অনুপ্রেরণা দিবে।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, তার (বেগম মুশতারী শফী) নিকটাত্মীয়-স্বজনদের মৃত্যুর পরও তিনি মুক্তিযুদ্ধে সাহসী সৈনিক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। আজকে বিশেষ করে জাতি তার কাছে কৃতজ্ঞ, যখন নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ধারা আমাদের দেশ থেকে নির্বাসিত, যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনরুদ্ধার করা অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে উঠেছে; সেই কর্তব্য পালনেও তিনি অসাধারণ ভুমিকা পালন করেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তার প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
তাহসীন শফী জানিয়েছেন, আজ বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা শেষে নিজ বাড়ি চট্টগ্রামের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হবে। আগামীকাল সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সর্বস্তরের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে এবং গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে। পরে চট্টগ্রাম মসজিদুল ফালায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে চৈতন্য গলিতে তাকে সমাহিত করা হবে।সৌজন্যে-বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post