শিক্ষার আলো ডেস্ক
হাত-পা আছে, কিন্তু অকেজো। মনে শক্তি থাকলেও দাঁড়াতে পারেন না। স্পষ্টভাবে কথাও বলতে পারেন না। যেন বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না। শারীরিক এই প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন জোবায়ের হোসেন উজ্জ্বল। মুখ দিয়ে উত্তরপত্র লিখে করেছেন এইচএসসি জয়। মেধাযুদ্ধে জিপিএ-৪.৫৮ পেয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে জোবায়ের হোসেন উজ্জ্বলের গ্রামের বাড়িতে যান মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাতেমাতুজ জোহরা। এ সময় তিনি উজ্জলের খোঁজখবর নেন।
পরে উজ্জলকে এমন সাফল্যময় ফলাফলের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে পাঁচ হাজার টাকার একটি চেক হাতে তুলে দেন ইউএনও ফাতেমাতুজ জোহরা। একই সঙ্গে উজ্জলকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও স্বপ্নপূরণে সার্বিক সহযোগিতার অশ্বাস দেন তিনি।
ইউএনও ফাতেমাতুজ জোহরা বলেন, আমরা চাই তাঁর অদম্য অগ্রযাত্রা যেন থেমে না যায়। উজ্জল যেন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। এজন্য জেলা ও উপজেলা প্রাশাসন তার পাশে থেকে সহযোগিতা করবে।
এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মিঠাপুকুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা গোলাম রব্বানী। তিনিও উজ্জলকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, রংপুরের জেলা প্রশাসক এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের সহায়তায় ইতোমধ্যে উজ্জলকে একটি ল্যাপটপের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভতিষ্যতে তার স্বপ্ন পূরণ হোক এটাই আমাদের চাওয়া।
জোবায়ের হোসেন উজ্জ্বল মিঠাপুকুর উপজেলার বালারহাট ইউনিয়নের হযরতপুর গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক জাহিদ সারোয়ারের ছেলে। বাবা-মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। জন্মের পর থেকে নানা রকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় বেড়ে ওঠেন উজ্জ্বল। নিজ বিছানাকে শ্রেণিকক্ষ বানিয়ে দিনরাত মুখে কাঠি নিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে চলত তার পড়াশোনা।
এর মধ্যেও পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন উজ্জ্বল। তিনি এসএসসি পাস করেছেন বালারহাট ইউনিয়নের শেরপুর দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে। এসএসসিতে পেয়েছেন জিপিএ-৪.৩৩। পরে ভর্তি হন বালাহাট আদর্শ মহাবিদ্যালয়ে। শতকষ্টকে মেনে নেওয়া উজ্জ্বল বিদ্যাঙ্গনে না গেলেও বাসায় থেকে মুখ দিয়ে মোবাইল ফোন চালিয়ে অনলাইনে ক্লাসও করতেন। মুখে কাঠি নিয়ে কিবোর্ডে আঁচড় ফেলে কম্পিউটারে টাইপ করতেন।
২০২১ সালে বালারহাট আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন জোবায়ের হোসেন উজ্জ্বল। মেধাযুদ্ধের এই পরীক্ষায় জিপিএ- ৪.৫৮ পয়েন্ট নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে কৃতকার্য হন। নিজের সাফল্যে আত্মহারা অদম্য এই শিক্ষার্থী।
জোবায়ের হোসেন উজ্জ্বল বলেন, সব প্রতিকূলতাকে হারিয়ে এভাবেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। আরও পড়ালেখা করে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই। আমার হাত-পা অচল, স্পষ্ট করে কথা বলার শক্তি নেই। তারপরও থেমে থাকিনি। ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখেছি। এখন স্বপ্ন পূরণে সবার ভালোবাসা ও সহযোগিতা চাই।
উজ্জ্বলের বাবা জাহিদ সারোয়ার বলেন, এসএসসি পাস করার পর উজ্জ্বলকে বালারহাট কলেজে ভর্তি করি। করোনার কারণে অটোপাস দেওয়ার খবরে তার মন খারাপ ছিল। তার ইচ্ছা ছিল পরীক্ষা দিয়ে সে এইচএসসির বাধা টপকাবে। পরে সশরীরে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত শুনে সে দারুণ খুশি হয়েছিল। বাসা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে অটোরিকশায় শুয়ে সে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়া-আসা করত। কেন্দ্রে বিছানায় শুয়ে সব পরীক্ষা দেয় উজ্জ্বল। সে পরিবারের বোঝা না হয়ে সরকারি চাকরি করে আত্মনির্ভরশীল হতে চায়।
উজ্জ্বলের মা উম্মে কুলসুম বলেন, বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ছিল পরীক্ষার কেন্দ্র। অটোরিকশায় শুয়ে উজ্জ্বল যাওয়া-আসা করত। কেন্দ্রে বিছানায় শুয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। সে চাকরি করে স্বাবলম্বী হতে চায়।
বালারহাট আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. আলাউদ্দিন বলেন, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধী হওয়ার পরও লেখাপড়ার দিকে মেধাবী উজ্জ্বলের চম্বুক টান ছিল। সে যে ফল বয়ে এনেছে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থীও তা করতে পারেনি। শুয়ে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বোর্ড থেকে অনুমতি নেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। আমরা চাই প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে সে জীবনে আরও ভালো কিছু করুক।সৌজন্যে-ঢাকা পোষ্ট
Discussion about this post