আমানুর রহমান রনি
দেশের সর্বত্র ক্ষুদ্র ঋণের নামে নৈরাজ্য ও প্রতারণা চলছে। স্থানীয়ভাবে নামে-বেনামে শতশত সমিতির মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে। কেউ কেউ সমবায় সমিতির নামে শরিয়া ভিত্তিক ব্যাংকিং চালু করেও প্রতারণা করছে। অধিক মুনাফা ও লাভের প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে নিঃস্ব করার এই অবৈধ হাতিয়ার এখনই নিয়ন্ত্রণের অনুরোধ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
উত্তরণ ডেভেলপমেন্ট নামে একটি ভুয়া ঋণ প্রদান কোম্পানি খুলে প্রতারণা মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগে তুরাগ এলাকা থেকে সম্প্রতি একজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগ। তার নাম শহিদুল ইসলাম ওরফে লিমন।
গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের লালবাগ জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার শামসুল আরেফীন জানান, একটি চক্র প্রতারণার উদ্দেশ্যে উত্তরণ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি নামে একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ২-৩ মাসের জন্য অফিস ভাড়া নেয়। এরপর তারা পত্রিকায় কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয়। কর্মী নিয়োগ করে গ্রাহক সংগ্রহ করার জন্য নিয়োগকৃত কর্মীদের তাদের নিজ বাড়ি এলাকায় পাঠিয়ে দেয়। প্রতারক চক্র প্রতারণার উদ্দেশ্যে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার নামে ১০ শতাংশ হারে সিকিউরিটি হিসেবে গ্রাহকদের কাছ থেকে নিয়োগ করা কর্মীদের মাধ্যমে অর্থ আদায় করে। পরে গ্রাহককে ঋণের সমপরিমাণ অর্থে ব্যাংক চেক প্রদান করে। ঋণ গ্রহীতারা ব্যাংকে টাকা উত্তোলন করতে গেলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের অ্যাকাউন্টে টাকা নেই বলে জানায়। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিমান বন্দর থানায় এক ভুক্তোভোগী মামলা করেন।
এই প্রতারক চক্রটি গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নিয়ে অফিস বন্ধ করে দেয় ও মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে।
এর আগে ২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শাহ আলী এলাকায় ক্ষুদ্র ঋণদান সমিতির নামে অবৈধ ব্যাংকিং লেনদেনের অপরাধে তিন জনকে গ্রেফতার করে র্যাব-৪। তারা মানুষকে অধিক মুনফা দেওয়ার কথা বলে প্রতিদিন আমানত সংগ্রহ করতো।
র্যাব-৪ এর অধিনায়ক ডিআইডি মোজাম্মেল হক বলেন, ‘প্রতারক চক্রটি ‘শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যাংকের মতো লেনদেন করে আসছিল। প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ (৫০)-সহ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি শিবপুর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি লিমিটেড হিসেবে রেজিস্টার্ডভুক্ত হলেও প্রতারণামূলকভাবে ‘শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামে প্রচার ও বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।
প্রতারণার কৌশল
সদস্য সংগ্রহ
এই প্রতারক চক্রের মাঠ পর্যায়ের কর্মী/সদস্যদের মাধ্যমে বিভিন্ন বস্তি এলাকার প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক, সেলুনের কর্মচারী, মনোহারী ও ফুটপাতের দোকানদার, গৃহকর্মী ও নিম্নআয়ের মানুষকে টার্গেট করে। ঋণের লোভ দেখিয়ে সঞ্চয়ের নামে তাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ/ডিপিএস করতে উদ্বুদ্ধ করে।
সঞ্চয় সংগ্রহ
এরা ভুক্তভোগীদের প্রলুব্ধ ও বিভিন্ন তথ্যাদি সংগ্রহ করে নানান কৌশলে ভুলিয়ে প্রতারক চক্রের অফিস কার্যালয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে। অধিক মুনফা দেওয়ার কথা বলে দৈনিক সঞ্চয় সংগ্রহ করে।
অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম
মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্প প্রচার করে। যেমন: মুদারাবা ডিপোজিট স্কিম, মুদারাবা কোটিপতি বিশেষ সঞ্চয়। এছাড়াও ডিপোজিট স্কিম, পেনশন ডিপোজিট ইত্যাদির প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষ, প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুকদের কাছ থেকে প্রতারণামূলকভাবে নগদ অর্থ হাতিয়ে নেয়।
স্বল্প সময়ে ঋণ দেওয়ার প্রলোভন
গ্রেফতার ব্যক্তিরা ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে অল্প সময়ে ঋণ দেওয়ার নিশ্চয়তা দিতো। ভুক্তভোগীদের বলা হয়, ১০-১৫ দিন ঠিকমতো নির্দিষ্ট হারে সঞ্চয় দিলে, তাদের ঋণ প্রদান করা হবে। যাতে করে তারা সুন্দরভাবে ব্যবসা করতে পারে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের দু’-এক জনকে ঋণ দিলেও কেউ সঞ্চয় থেকে ঋণ পেতো না।
ফ্ল্যাট/জমি দেওয়ার আশ্বাস
প্রতারণার আর একটি কৌশল হিসেবে ভুক্তভোগীদের বোঝানো হতো যে, দৈনিক মাত্র ২০০-৩০০ টাকা করে জমা করলে একসময় ঢাকা শহরে তাদের একটি করে ফ্ল্যাট বা জমি দেওয়া হবে।
সময়ায় সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটিতে একই পরিবার
র্যাবের হাতে গ্রেফতার ফয়েজ উল্লাহ নিজেই তার সমিতির সভাপতি। সহ-সভাপতি তার বন্ধু পলাতক সিরাজুল ইসলাম, সম্পাদক তার স্ত্রী পলাতক আসামি রোকেয়া বেগম, যুগ্ম সম্পাদক শ্যালক আলাউদ্দিন, কোষাধ্যক্ষ ছেলে আরিফ হোসেন এবং সদস্য তার বন্ধু মো. জামিল হোসেন ওয়াদুদ। সমিতির কার্যকরী সমিতির সব সদস্য তার স্ত্রী, সন্তান ও বন্ধুরা।
এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদিত নয়; যা সম্পূর্ণ অবৈধ। এনজিও হিসেবে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি আর্থিক লেনদেনের জন্য অনুমোদিত নয়।
অনুমোদন ছাড়া সারা দেশে এ রকম অসংখ্য সমিতি ও মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এদের যথাযথ মনিটরিং না করায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করার তো কোনও অধিকার নেই তাদের। এ জন্য রেগুলেটরি বডি রয়েছে। তাদের উচিত এদের এখনই প্রতিরোধ করা।’ courtesy- banglatribune
Discussion about this post