বিনোদন প্রতিবেদক
তুমুল জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ড ‘এলআরবি’র প্রতিষ্ঠাতা তিনি। একজন গায়ক। তবে গিটার হাতে তিনি যেন হ্যামিলনে বাঁশিওয়ালা। তাকে বলা হয় ‘গিটারের জাদুকর’। কেউ তাকে ভালোবাসেন রুপালি গিটারের আইয়ুব বাচ্চু হিসেবে। তিনি আজ নেই।
আইয়ুব বাচ্চুর আজ জন্মদিন। এই দিনে তারকার ভক্ত-অনুরাগীরা তাকে স্মরণ করছেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রক তারকা আইয়ুব বাচ্চু। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর সকালে অগণিত ভক্তদের কাঁদিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন সবার পছন্দের এই মানুষটি।
চট্টগ্রামের সরকারি মুসলিম হাইস্কুলে আইয়ুব বাচ্চুর শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি হয়। তবে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ১৯৭৮ সালে যোগ দেন ব্যান্ড ফিলিংসে। শহীদ মাহমুদ জঙ্গির ‘হারানো বিকেলের গল্প’ গানে প্রথম কণ্ঠ দেন আইয়ুব বাচ্চু। এরপর ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলসে গান গেয়েছেন তিনি।
সোলসে থাকার সময়ই ১৯৮৬ সালে তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’ বের হয়। ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘ময়না’ মুক্তি পায়। ১৯৯০ সালের পর থেকেই নিজের ব্যান্ড গড়বেন বলে মনস্থির করেন আইয়ুব বাচ্চু। সেই সূত্রে ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে তাঁর ব্যান্ড ‘লিটল রিভার ব্যান্ডস’, সংক্ষেপে ‘এলআরবি’। পরে অবশ্য নাম পরিবর্তিত হয় : ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’, সংক্ষিপ্ত রূপ অবশ্য সেই এলআরবি-ই থাকে। এরপর তিনি হয়ে উঠতে থাকেন বাংলা ব্যান্ড সংগীতের এক ইতিহাস। ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশে প্রথম ডাবল অ্যালবাম এলআরবি-১ ও এলআরবি-২ ব্যাপক সাড়া জাগায় শ্রোতাদের মাঝে।
এরপর নিয়মিত প্রকাশ পেতে থাকে ‘সুখ’, ‘তবুও’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘স্বপ্ন’, ‘আমাদের বিস্ময়’, ‘মন চাইলে মন পাবে’, ‘অচেনা জীবন’, ‘মন আছে নাকি নাই’, স্পর্শের মতো অ্যালবাম। সুখ অ্যালবামের ‘সুখ’, ‘চলো বদলে যাই’, ‘রুপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’ উল্লেখযোগ্য গান। ‘চলো বদলে যাই’ বাংলাদেশের সংগীত জগতে অন্যতম জনপ্রিয় একটি গান। গানটির কথা লিখেছেন ও সুর করেছেন বাচ্চু নিজেই। ২০১২ সালে ব্যান্ডটির সর্বশেষ অ্যালবাম ‘যুদ্ধ’ বের হয়েছে। ব্যান্ডটির একমাত্র লাইভ অ্যালবাম ‘ফেরারী মন’ ১৯৯৬ সালে মুক্তি পায়।
সোলসে থাকার সময় দুটি একক অ্যালবামের কাজ হলেও নিজের ব্যান্ড তৈরির পর সেদিকে আবারও নজর দেন আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৯৫ সালে চতুর্থ ব্যান্ড অ্যালবাম ‘ঘুমন্ত শহরে’র সঙ্গে তিনি বের করেন তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। সর্বকালের সেরা একক অ্যালবামের একটি বলে অবিহিত করা হয় এটিকে। এই অ্যালবামের প্রায় সব গানই জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ‘কষ্ট কাকে বলে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হৃদয়’ ও ‘আমিও মানুষ’।
বাংলা ব্যান্ড জগতের জনপ্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের একজন আইয়ুব বাচ্চু মঞ্চ পারফরম্যান্সে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শ্রোতা-ভক্তদের কাছে ‘এবি’ নামে পরিচিত এই গুণীশিল্পীর ডাকনাম রবিন। মূলত রক ধাঁচের কণ্ঠের অধিকারী হলেও আধুনিক, ক্লাসিকাল সংগীত এবং লোকগীতি গেয়েও শ্রোতাদের মুগ্ধতায় ভাসিয়েছেন ‘এবি’।
আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’ প্রকাশ হয়েছিলো ১৯৮৬ সালে। এই অ্যালবামটি তেমন একটা সাফল্য পায়নি। আইয়ুব বাচ্চুর সফলতার শুরু তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’ (১৯৮৮) দিয়ে।
১৯৯১ সালে বাচ্চু ‘এলআরবি’ ব্যান্ড গঠন করার পর এই ব্যান্ডের সঙ্গে তার প্রথম অ্যালবাম ‘এলআরবি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এটি বাংলাদেশের প্রথম দ্বৈত অ্যালবাম। এই অ্যালবামের ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙ্গা শহরে’, ‘হকার’ গানগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো।
চলচ্চিত্রে গান করেও দুর্দান্ত সাড়া পান আইয়ুব বাচ্চু। তার গাওয়া ‘আম্মাজান’ সিনেমার টাইটেল সংটি সারাদেশের মানুষের কাছে আজও জনপ্রিয়। এছাড়াও তিনি ‘একঝাঁক পাখি ওড়ে আকাশে’, ‘সাগরিকা’সহ বহু শ্রোতাপ্রিয় গান সিনেমায় গেয়েছেন।‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ বাংলা ছবির অন্যতম একটি জনপ্রিয় গান। এটি তাঁর গাওয়া প্রথম চলচ্চিত্রের গান। ছবিটির নাম ছিল ‘লুটতরাজ’।
আইয়ুব বাচ্চুর অসংখ্য জনপ্রিয় গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘সেই তুমি কেন এতো অচেনা হলে’, ‘এক আকাশের তারা তুই একা গুনিসনি’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘উড়াল দেবো আকাশে’, ‘আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো, ‘এই রূপালি গিটার ফেলে একদিন…’।
ব্যক্তিগত জীবনে আইয়ুব বাচ্চু ফেরদৌস চন্দনাকে বিয়ে করেন। তাঁদের ঘরে জন্ম নেয় পুত্র ফাইরুজ ও কন্যা তাজওয়ার।
২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর ফুসফুসে পানি জমে যাওয়ার কারণে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। তবে সুস্থ হয়ে আবার সংগীতজগতে ফিরলেও হৃদরোগের সমস্যায় ভুগেছেন তিনি। ২০০৯ সালে হার্টে রিং পরাতে হয়েছে তাঁর। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ১৬ অক্টোবর রংপুর জিলা স্কুলের মাঠে ‘শেকড়ের সন্ধানে’ শিরোনামের একটি অনুষ্ঠানে কনসার্টে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ঢাকায় ফিরে আসার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন আইয়ুব বাচ্চু।
২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর মগবাজারে নিজ বাসভবন থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে হার্ট অ্যাটাকের কারণে বাংলা ব্যান্ড সংগীতের এই মহাতারকার মৃত্যু হয়। বাংলা সংগীতজগতে তাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
Discussion about this post