বিশেষ প্রতিবেদক
৩৪ একরের ছোট্ট ক্যাম্পাস, কিন্তু হাজারো নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ভবিষ্যৎ গড়ার মাধ্যম। উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হওয়ার পর দেশের হাজারো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন নিভে যাওয়ার শঙ্কা থাকে শুধু আর্থিকভাবে খুব বেশি সচ্ছল না হওয়ার কারণে। এদের কথা বিবেচনা করে, তাদের ভবিষ্যৎকে একটি সুন্দর পরিণতি দিতে বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে গড়ে ওঠে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে হাজারো শিক্ষার্থীর সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। বলছিলাম বাইশ পেরিয়ে তেইশ বছরে পদার্পণ করা সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে ২২টি বছর পাড়ি দিয়ে আজকের এই অবস্থানে আসা গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে রয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এক রোমাঞ্চকর ইতিহাস আর এই ইতিহাসের নির্মাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কথা। যার নামের সঙ্গে মিশে আছে মুক্তিযুদ্ধের অভূতপূর্ব সংগ্রামী অধ্যায়।
গণ বিশ্ববিদ্যালয় একজন স্বাস্থ্য হিরো, নারী ক্ষমতায়নের অগ্রদূত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আদর্শে গড়া প্রতিষ্ঠান বলেই হয়তো অলাভজনক ও ব্যতিক্রমী হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ২২ বছরে এতদূর এগিয়ে গেছে। কেননা তাঁর প্রতিষ্ঠানটিতে নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানের জন্য, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের জন্য, প্রতিবন্ধী এবং উপজাতি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি, বিনা বেতনে অধ্যয়ন, টিউশন ফি ছাড়সহ নানান সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
রাজধানীর অদূরে সাভার উপজেলার নলাম গ্রামে ১৯৯৮ সালের ১৪ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় গণ বিশ্ববিদ্যালয়। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক জাতি গঠন ও দেশের বিদ্যমান দারিদ্র্যের বিপরীতে উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তারই অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে অত্যন্ত কম, যা দেশের অন্যান্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যায়। টিউশন ফি কম হলেও শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাপ্য কোনো সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও গ্রাম্য আবহের মিশেলে গড়া প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে বিশাল একাডেমিক ভবন। বর্তমানে এখানে ৪টি অনুষদের আওতাধীন ১৭টি বিভাগ চালু রয়েছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি মাস্টার্স কোর্সও চালু আছে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে সহায়তার জন্য যাবতীয় সব প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা হয়েছে এবং বাকিগুলো পূরণের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির জন্য বিষয়ভিত্তিক হাজারো বইসমৃদ্ধ সুবিশাল গ্রন্থাগার, আধুনিক উপকরণসমৃদ্ধ ল্যাবরেটরি, এজলাস, ভেটেরিনারি হাসপাতাল, ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধা ইত্যাদি সবই রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামকে একধাপ এগিয়ে নিতে ভূমিকা পালন করে চলেছে সর্বশেষ চালু হওয়া ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমাল সায়েন্সেস বিভাগ। ২০১৬ সালের মে মাসে চালু হওয়া বিভাগটি বর্তমানে দেশের প্রথম ও একমাত্র প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণ বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ানো হয়। অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রেও দারুণ গতিতে এগিয়ে চলেছে নব্য প্রতিষ্ঠিত এই বিভাগটি। ভেটেরিনারি শিক্ষার জন্য যেসব সুবিধাদি প্রয়োজন তার সিংহভাগই প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে বেশকিছু ব্যতিক্রমধর্মী পরিচয়। আগেও বিভিন্ন বিষয়ে ব্যতিক্রম কিছু করে সুনাম অর্জন করা গণ বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি দারুণ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। সমাজের অবহেলিত, নির্যাতিত, লাঞ্ছিত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তথা হিজড়াদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছে প্রশাসন। নিয়োগ দেয়ার আগে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ সদস্যের একটি টিম। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যতিক্রমধর্মিতার আরেক পরিচয় ‘গণ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ’ তথা গাকসুর উপস্থিতি। দেশের প্রথম ও একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শুধু গণ বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে ছাত্রসংসদ। দুই বছর পরপর ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে অত্যন্ত সুষ্ঠু পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচন হয়। এমনিতে ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চায় ও শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি পূরণে কাজ করে চলেছে গাকসু। এ ছাড়া দেশের প্রথম ও একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করে গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (গবিসাস)। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাওয়া গবিসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব গৌরবময় অর্জন তথা সাফল্যের ক্ষেত্রে খেলাধুলার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধাকে অগ্রাধিকার দিতে রয়েছে কেন্দ্রীয় ফুটবল ও ক্রিকেট মাঠ, বাস্কেটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন ও টেনিস কোর্ট। সরকারের খেলাধুলার প্রতি গুরুত্বের দিকটাকে সম্মান জানিয়ে এখানে পড়ালেখার পাশাপাশি ক্রীড়া ক্ষেত্রকে আলাদাভাবে স্থান দেয়া হয়েছে। প্রতিবছরে দুইবার ক্রীড়া উৎসবে মেতে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস। ফুটবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবল, ভলিবল, বাস্কেটবলসহ নানা ইভেন্টে ইভেন্ট চারটি হচ্ছে- মেয়েদের ফুটবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবল ও ছেলেদের ফুটবল।
২০১৯ বঙ্গবন্ধু স্পোর্টস চ্যাম্প ফুটবলে নারী এবং পুরুষ দুটো দলই চ্যাম্পিয়ন হয়। ওই টুর্ণামেন্টে সাতটি ইভেন্টে অংশ নিয়ে চারটিতেই তারা চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর ফারাজ গোল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ন এবং এবারের ২০২০ বঙ্গবন্ধু স্পোর্টস চ্যাম্পেও মেয়েরা দু’টি খেলায় ফাইনালে পৌঁছেছে।জাতীয় প্রমীলা দলের ফুটবল অধিনায়ক সাবিনা খাতুন ছাড়াও আরো দুজন নামকরা খেলোয়াড এই প্রতিষ্ঠানে পড়ছে।
জাতীয় প্রমীলা হ্যান্ডবল দলের খেলোয়াড ছন্দা রাণী সরকারও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।পথচলার ২২ বছরে অনেক অনেক অর্জন আর অনেক সুখ্যাতি বয়ে নিয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটি সামনের দিনগুলোতে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে, অর্জনের পরিধি ক্রমশ বাড়াতে থাকবে এটাই কামনা করে এই প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলো। এই প্রতিষ্ঠানের একজন হিসেবে গর্ববোধ করার খ্যাতিটা সবসময় উজ্জ্বল থাকবে, এটাই চান তারা।
Discussion about this post