বিশেষ প্রতিবেদক
প্রথমবারের মতো কওমি মাদরাসার ছাত্ররা তাদের বোর্ড বেফাকের (বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ) বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাঠে নামতে যাচ্ছে। মহাসচিবসহ অভিযুক্তদের পদত্যাগের দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে ‘কওমি ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন। যদিও সংগঠনটির নেতৃত্বে কারা রয়েছেন, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। হতে পারে এটা তাদের কৌশল। তবে, তাদের দাবি সম্বলিত পোস্টার ফেসবুকে তরুণ আলেমরা শেয়ার করছেন।
দাবি মানা না হলে সংগঠনটি শুক্রবার (১৭ জুলাই) বাদ আসর বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে মানবন্ধন করবে ও সেখান থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে জানিয়েছে। কওমি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলন নজীরবিহীন। এতোদিন তারা ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করে এসেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কয়েকটি অডিও ক্লিপ ফাঁস হওয়ার প্রেক্ষিতে শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ এবং নানা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফসহ তিনজনকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করেছে বেফাক। তাতেও ক্ষোভ কমছে না আলেম-উলামা ও ছাত্রদের। তাদের দাবি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ফোনালাপে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এ পর্যন্ত বেফাকে হওয়া সব অনিয়মের বিচার করতে হবে। শুধু মাওলানা আবু ইউসুফ কিংবা তার সহযোগী নয়, মহাসচিবসহ যারা এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সবার বিচার করতে হবে।
তবে মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) প্রতিষ্ঠানটির সহ-সভাপতি আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রূদ্ধদার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় আপাতত তিনজনকে বহিস্কার করে মহাসচিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করা হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিভিন্ন অভিযোগে অনেককে চাকরি থেকে বরখাস্ত নজীর থাকলেও একসঙ্গে তিনজনকে অনিয়ম ও বেফাকের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে জড়িত থাকায় বরখাস্ত করার ঘটনা এবারই প্রথম। বরখাস্ত তিনজনই বেফাক মহাসচিবের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। তন্মধ্যে পরীক্ষা বিভাগে সঙ্গে কর্মরত ফরিদাবাদ মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুল গণী বেফাক মহাসচিবের মাদরাসার শিক্ষক এবং সম্পর্কে মাওলানা আবদুল কুদ্দসের চাচা।
হাটহাজারী মাদরাসার শুরা সদস্য মাওলানা আবদুল কুদ্দুস ও মাওলানা নুরুল আমিন যথাক্রমে বেফাকের মহাসচিব ও সহকারী মহাসচিব। হাটহাজারীর হুজুর আল্লামা আহমদ শফীর আস্থাভাজন বলে পরিচিত। আর সভাপতি আল্লামা শফী হচ্ছেন বেফাকের সভাপতি। এমতাবস্থায় হাটহাজারী মাদরাসার সহকারী পরিচালকের পদ থেকে মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে সরিয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন এ দুইজন। এটা নিয়ে আলেম-উলামা ও ছাত্রদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ জন্ম নেয়। এরই প্রেক্ষাপটে ফরিদাবাদ মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুল কুদ্দুস ও সহকারী প্রিন্সিপাল মাওলানা নুরুল আমিনের বিভিন্ন অন্যায়, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কথা প্রকাশ হতে থাকে যোগাযোগ মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় বেফাকের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফের সঙ্গে মাওলানা আবদুল কুদ্দস, মাওলানা নুরুল আমিন, মাওলানা আবদুল গণী, মাওলানা আনাস মাদানী ও মাওলানা ত্বহার কথোপকথনের একাধিক অডিও ভাইরাল হয়।
ফাঁস হওয়া পাঁচটি অডিও ক্লিপের একটিতে বেফাকের মহাসচিব ও আল হাইয়াতুল উলিয়ার ভারপ্রাপ্ত কো-চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল কুদ্দুস এবং বেফাকের পরীক্ষানিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফ, আরেকটিতে বেফাকের সহ-সভাপতি মাওলানা আনাস মাদানী ও বেফাকের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফের কথোপকথন রয়েছে। পাওয়া গেছে বেফাকের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফ এবং ঢাকার ফরিদাবাদ মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস, বেফাকের পরীক্ষা বিভাগের অতিথি কর্মকর্তা মাওলানা আবদুল গনীর মধ্যকার নানা বিষয়ে কথোপকথন।
সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পাওয়া গেছে বেফাকের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফের বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় পরীক্ষার মেধা তালিকা নিয়ে সিরিয়াল জালিয়াতি, পরীক্ষার মারকাজ নিয়ে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি, মুরব্বি আলেমদের নামে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারসহ নানা অনিয়ম। এসব অভিযোগের বিষয়ে অনেক আগে থেকেই মাওলানা আবু ইউসুফের বিরুদ্ধে একটি তদন্ত দল কাজ করছে। বেফাকের ১০ সদস্যের ওই তদন্ত কমিটিতে আছেন- মুফতি ওয়াক্কাস, মাওলানা সাজিদুর রহমান, মাওলানা নুরুল ইসলাম, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা মুসলেহ উদ্দীন রাজু, মাওলানা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া, মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা নুরুল আমিন ও মাওলানা মনিরুজ্জামান। ওইসব অভিযোগের এখন সুরাহা হয়নি। নতুন অভিযোগের প্রেক্ষিতে বহিস্কার হতে হলো।
মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) বেফাকের মিটিংয়ে মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দসকে পদত্যাগ করতে বলা হলেও তিনি অস্বীকৃতি জানান। তাকে সমর্থন করেন মাওলানা আনাস মাদানী এবং মাওলানা সাজিদুর রহমান। মহাসচিব এ সময় বলেন, আমি এভাবে পদত্যাগ করবো না। আমি এখান থেকে কয়েকজনকে নিয়ে গিয়ে হাটহাজারী হুজুরের সাথে কথা বলবো। এরই প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) হাটহাজারীতে বেফাকের খাস কমিটির বৈঠক আহ্বান করেও বাতিল করা হয়েছে। বেফাকসূত্রে জানা গেছে, আল্লামা শফী এখন বলতে গেলে সংজ্ঞাহীন। তার এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার মতো সামর্থ্য নেই। মূলত আল্লামা শফীর দোহাই দিয়ে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে।
বেফাকের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি কেউ। একাধিক সহ-সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চলমান বিষয়গুলো খুব স্পর্শকাতর। এগুলো নিয়ে মুরব্বিরা কাজ করছেন। এর বেশি মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।
Discussion about this post