বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি
শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সংগ্রাম, ঐতিহ্য ও সাফল্যের বহুমাত্রিকতায় অনন্য দেশের উচ্চশিক্ষার প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সৌরভকে দেশের সীমা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক পরিসরে ছড়িয়ে দিতে ইতোমধ্যে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। এসবের মধ্যে অন্যতম একটি হলো- ‘জালিয়াতি প্রতিরোধ কমিটি’ বা ‘প্লেজারিজম প্রিভেনশন কমিটি’। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উদ্যোগ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষায় নতুন মাত্রা যুক্ত করবে বলে প্রত্যাশা কর্তৃপক্ষের।
যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য হচ্ছে, জ্ঞানদান, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি এবং তা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ। আর এর মাধ্যম হচ্ছে গবেষণা। তবে সম্প্রতি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রত্যাশা অনুযায়ী মান সম্পন্ন গবেষণা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার কখনো কখনো গবেষণার ক্ষেত্রে নেয়া হয় চৌর্যবৃত্তির আশ্রয়। সঠিক নীতিমালা ও তদারকির অভাবে গবেষণা জালিয়াতি বন্ধ হচ্ছে না বলে অভিযোগ শিক্ষাবিদদের। পাশাপাশি শিক্ষার মূল্য কমে যাওয়ায় গবেষণা হচ্ছে না বলে মন্তব্য তাদের।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কোনো আলাদা জিনিস নয় এটা সমাজেরই অংশ। সমাজে যখন জ্ঞানের মূল্য কমে যায় তখন বিশ্ববিদ্যালয়েও জ্ঞানের অনুশীলন কমে যায়। আমাদের সমাজে এখন জ্ঞানের মূল্য খুব বেশি না। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘জ্ঞানের মূল্য কমে যাওয়ায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়ন করতে পারছি না। এখন মান উন্নয়ন করতে হলে আমাদেও গবেষণা-প্রকাশনা করতে হবে। কিন্তু এই গবেষণা-প্রকাশনা হবে না বিশ্ববিদ্যালয় যদি এর মূল্য না দেয়। গবেষণা ছাড়া যদি প্রমোশন হয় তবে এতে তারা আসবে কেন?’ এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তার মর্যদা সমুন্নত রাখতে হলে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শতভাগ মেধার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে বৈশ্বিক পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান সমুন্নত করতে এবার গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি গবেষণা জালিয়াতি রুখতে কমিটি করার মাধ্যমে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর মাধ্যমে জালিয়াতি নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তারা। সেই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ উদ্যোগ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও আলোর পথের সন্ধান দিবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় প্লেজারিজম প্রিভেনশন নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে এটি সাব কমিটি হিসেবে কাজ করছে। এই কমিটি ইতোমধ্যে খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করে ফেলেছে। কয়েকটি ধাপে কাজ শেষে সিন্ডিকেটের অনুমোদনের মাধ্যমে তা অর্ডিন্যান্স আকারে প্রকাশ পাবে।
সূত্র জানায়, আলাদা তিন অনুষদের তিন জন ডিনকে নিয়ে গঠিত হয়েছে এই সাব কমিটি। তিন সদস্যের এই কমিটিতে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিমকে আহবায়ক করা হয়েছে। কমিটিতে অন্য দু’জন সদস্য হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য এবং ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মো. হাসানুজ্জামান এবং আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. রহমত উল্লাহ।
কমিটি প্রণীত নীতিমালা অনুষদগুলোতে যাবে। পরে তা ডিনস কমিটিতে পাঠানো হবে। ডিনস কমিটির সুপারিশ শেষে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সিন্ডিকেটে যাবে। সিন্ডিকেট তা চূড়ান্ত করলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্সের অন্তর্ভুক্ত হবে।
এছাড়াও গবেষণা জালিয়াতি বন্ধে বিভাগ ও ইনস্টিটিউটগুলোতে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কোনো গবেষণা জমা নেয়ার ক্ষেত্রে বিভাগ থেকেই একটি প্রাথমিক মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা থাকবে। কতটুকু কপি রয়েছে, কি পরিমাণ গ্রহণ করা হবে, কি পরিমাণ হলে তা রিভিউ করতে হবে এসব বিষয়ে নির্দেশনা দিবে এই কমিটি।
জানতে চাইলে কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘কমিটি ইতোমধ্যে একটা খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। আমাদের দেশের পরিসরে পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা সম্ভব না হলেও আমরা চেষ্টা করছি। সেক্ষেত্রে ভারতসহ অন্যান্য প্রতিবেশি রাষ্ট্রের নীতিমালাগুলো দেখেছি। এছাড়াও আমেরিকা ও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ সংক্রান্ত নীতিমালার সাথে সমন্বয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
জানতে চাইলে কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমাদের খসড়া নীতিমালার প্রণয়ন করা হয়েছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সাথে কথা বলছি। আইন অনুষদের ডিন এখানে আইনের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করছেন। আর ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন বৈজ্ঞনিক এবং টেকনিক্যাল বিষয়গুলো দেখছেন। সর্বোপরি আমাদের স্ট্যান্ডার্ডটা যেন আন্তর্জাতিক মানের হয় সেজন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘গবেষণা জালিয়াতি রোধে প্লেজারিজম প্রিভেনশন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও আরো কয়েকটি কমিটি হয়েছে। কমিটি গঠনের মাধ্যমে মনিটরিং করা হবে। আমরা আশাবাদী যে, কমিটিগুলোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে অপরাধপ্রবণতা ক্রমশঃ কমে যাবে।’
Discussion about this post