মুসতাক আহমদ
এবার পহেলা জানুয়ারি ‘পাঠ্যপুস্তক উৎসব’ ঘিরে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত একটি বইও জেলা-উপজেলায় পাঠানো সম্ভব হয়নি।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণে মাধ্যমিকের বইয়ের মুদ্রণ কাজ আটকে গেছে। আর অন্তত তিনটি কারণে প্রাথমিকের বইয়ের মুদ্রণ কাজ বন্ধ করে হাত গুটিয়ে রেখেছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান।
এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের কাছে যথাসময়ে বিনা মূল্যের পাঠ্যবই পৌঁছানো নিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
আর মাধ্যমিকের বইয়ের প্রচ্ছদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পৃষ্ঠায় এবার স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন স্থিরচিত্র ক্যাপশনসহ যুক্ত করার ব্যাপারে বিলম্বিত সিদ্ধান্ত। এরপর সেই স্থিরচিত্র অনুমোদনেও বিলম্ব হওয়ার কারণে মুদ্রাকররা কাজ বন্ধ রেখেছেন।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা যুগান্তরকে বলেন, এটা ঠিক যে, এ বছর এখন পর্যন্ত কোনো বই আমরা পাঠাতে পারিনি; তবে রোববার থেকে প্রাথমিক স্তরের বই পাঠানো শুরু হবে।
মাধ্যমিক স্তরের কাজেরও অগ্রগতি দ্রুত হবে। কেউ যদি কাজ বন্ধ রাখে, তাহলে দরপত্রের শর্তানুযায়ী ক্ষতি তারই। কেননা, নির্ধারিত সময়ের পর বই সরবরাহ করলে তাকে আর্থিক শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। করোনা পরিস্থিতি এবং ইজিপিতে (অনলাইন) দরপত্রের কারণে গত বছরের চেয়ে দেরিতে কাজ শুরু করতে হয়েছে। তবে মুদ্রাকরদের বুঝিয়ে হলেও ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ তুলে আনা হবে।
এ বছর প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩৪ কোটি বই বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ১০ কোটি ২৫ লাখ ৮২ হাজার ৫৫৫টি প্রাথমিক স্তরের। বাকিগুলো মাধ্যমিক, দাখিল এবং ইবতেদায়ি স্তরের বই।
অন্যান্য বছর অক্টোবরে ৩৫ কোটি বইয়ের অন্তত ৬০-৭০ শতাংশ মাঠপর্যায়ে পাঠানোর কাজ শেষ হয়ে থাকে। কিন্তু এ বছর একটি বইও এখন পর্যন্ত পাঠানো হয়নি। দরপত্রের শর্তানুযায়ী, প্রাথমিকের বই ছাপতে মুদ্রাকররা ৯৮ দিন আর মাধ্যমিকের জন্য ৬০ দিন পেয়ে থাকেন।
কিন্তু এবার বইয়ের চুক্তি গত ৮ অক্টোবর শেষ হয়েছে। সেই হিসাবে মধ্য-জানুয়ারি পর্যন্ত মুদ্রাকররা বই ছাপার সময় পাবেন। এ সময়ের আগে বই না দিলে জরিমানারও সুযোগ নেই বলে জানা গেছে।
এদিকে বইয়ের মুদ্রণ কাজ শুরুতে বিলম্ব এবং বন্ধ করে রাখার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে এবারে কাগজের দাম অবিশ্বাস্যভাবে কমে গিয়েছিল।
গত বছর খোদ এনসিটিবিই যে কাগজ প্রতি টন ৯০ হাজার টাকার উপরে কিনেছে, এবার তারা সেটা কেনে ৬৫ হাজার টাকা করে। আর খোলা বাজারে এই কাগজের দাম ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেমেছিল। কিন্তু কাগজের মিলগুলো পরস্পর সংঘবদ্ধ হয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন মুদ্রাকররা। এ কারণে কাগজ কেনায় হঠাৎ হোঁচট খেয়েছেন মুদ্রাকররা।
তবে এর চেয়ে বড় কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আরও দুটি। প্রথমত, কাগজের মানে নতুন আরোপিত ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ (কাগজের শক্তি বা কতটুকু টান দিলে কাগজটি ছিঁড়ে যায়) যুক্ত করা হয়েছে। এটি হচ্ছে, ৮০ শতাংশ জিএসএম (পুরুত্ব) এবং ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতার পাশাপাশি বাস্টিং ফ্যাক্টর ১৬ থাকতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশে বেশিরভাগ কাগজ মিলই ১৪ মানের কাগজ উৎপাদন করে। ফলে দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে এই মানের কাগজ। দ্বিতীয়ত, প্রাথমিকের বইয়ের মুদ্রণ মান তদারকের কাজ পেয়েছে ব্যুরো ভেরিটাস নামে একটি প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হওয়া সত্ত্বেও রহস্যজনক কারণে এই প্রতিষ্ঠানটি কাজ পেয়েছে।
তাছাড়া ২০১৭ সালে প্রাথমিকেরই কাজ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পারফরমেন্স গ্যারান্টি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। এ নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) সঙ্গে তখন সম্পর্কের অবনতিও ঘটে। এ ছাড়া গত দু’বছর এই প্রতিষ্ঠানটি মাধ্যমিকের বইয়ের পরিদর্শনের কাজ পেয়েছিল।
কিন্তু নানান অভিযোগে এবার এনসিটিবি প্রতিষ্ঠানটিকে এ স্তরের কাজ দেয়নি। কিন্তু ডিপিই রহস্যজনক কারণে প্রাথমিকের কাজ দিয়েছে। মুদ্রাকরদের অভিযোগ, ওই প্রতিষ্ঠানটি পদে পদে বাধা সৃষ্টি করছে।
দৈবচয়ন ভিত্তিতে কাগজের মান যাচাইয়ের কথা থাকলেও রীতি ভেঙে এই কাজের (মান যাচাইয়ের) নামে হয়রানি করছে। প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতার ঘাটতি থাকায় একসঙ্গে বেশি পরিমাণ কাগজ কিনতে পারছে না মুদ্রাকররা।
অদক্ষ কর্মী নিয়োগ করায় স্যাম্পল নেয়ার সময় কাগজ নষ্ট করা হচ্ছে। এ ছাড়া কাগজ পরীক্ষার রিপোর্টের ছাড়পত্র মিলতে বিলম্ব হচ্ছে। এমন নানা অভিযোগে খ্যাপে বেশকিছু মুদ্রাকর কাজ বন্ধ রেখেছেন বলে বৃহস্পতিবার সরেজমিন পরিদর্শনকালে রাজধানীর বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
পরে এনসিটিবির এক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেছেন, প্রাথমিকের বইয়ের পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে ডিপিই। সংস্থাটিকে এ তথ্য জানিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এবারে প্রাথমিকের বই নিয়ে খুবই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সময়মতো বই ওঠানো বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে ব্যুরো ভেরিটাসের কান্ট্রি ম্যানেজার সোহেল আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানান, আপনি তো আমার প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। আপনার সঙ্গে কোনো কথা নেই।
একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. আফজাল বলেন, তারা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা ছিলেন। প্রথম দরদাতার সঙ্গে দরে তাদের বেশি পার্থক্য ছিল না, ২০-২২ লাখ টাকা।
প্রথম সর্বোচ্চ দরদাতার কাগজপত্রের ঘাটতি থাকায় তারা কাজটি পায়নি। আর তাদের প্রতিষ্ঠানের কখনও পারফরমেন্স গ্যারান্টি বাজেয়াপ্ত বা অন্য কোনো শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার কথা ঠিক নয়। কাগজ পরীক্ষায় তারা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করছেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম-আল-হোসেন বলেন, বইয়ের মুদ্রণ কাজ কতটা এগিয়েছে, তা আমাদেরকে বলবে এনসিটিবি। পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান যদি এ ক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা করে, তাহলে তারাও দরপত্রের শর্তানুযায়ী শাস্তির মুখোমুখি হবে।
কিন্তু সেই স্থিরচিত্র অনুমোদনেও বিলম্ব হয়। এ ছাড়া ছবি বাছাই আর ক্যাপশনের ভাষা নিয়েও মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরা অসন্তুষ্ট ছিলেন এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কমিটির ওপর। সব মিলিয়ে অনুমোদন প্রক্রিয়া বিলম্ব হয়।
গত মঙ্গলবার মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত অনুমোদনপত্র এনসিটিবি পেয়েছে। অন্যদিকে কভার অনুমোদন না পাওয়ায় মুদ্রাকররা মুদ্রণ কাজ বন্ধ করে রেখেছিলেন।
এর কারণ সম্পর্কে এক মুদ্রাকর বলেন, পাঠ্যাংশ মুদ্রণের পরপরই বাঁধাই না করলে কাগজ নষ্ট হয়ে যায়। তাই তারা আগে কভার ছাপেন। পরে পাঠ্যাংশ ছাপিয়েই বাঁধাই করে ফেলা হয়। কভার ছাপতে না পারায় বই ছাপাই আটকে যায়।
Discussion about this post