শিক্ষার আলো ডেস্ক
গত বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ৪৪৭টি গবেষণা নিবন্ধ বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ হয়েছে । এর মধ্যে মাত্র ১৮৪টির লেখক বিশ্ববিদ্যালয়কে সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এসব গবেষণা নিবন্ধের মাত্র সাতটিতে আর্থিক সহযোগিতা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ সংশ্নিষ্ট অর্থবছরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে গবেষণা খাতে তিন কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
বৈজ্ঞানিক জার্নাল, বুক রিভিউ এবং কনফারেন্স পেপার সম্পর্কিত সাইটেশনের উপাত্ত নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘স্কোপাস’-এর তথ্য পর্যালোচনায় এসব জানা যায়।
সংস্থাটির সর্বশেষ (চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি) তথ্যমতে, ১৮৪টি (৪৪.৪৪%) প্রকাশনা ছাড়াও বাকি ২৯৯টি প্রকাশনায় জাহাঙ্গীনগরের গবেষকদের অংশগ্রহণ রয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্বে পরিচালিত ১৪৫টি প্রকাশনায় বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষকরা রয়েছেন। কিছু প্রকাশনায় জাহাঙ্গীরনগর ও অন্য অংশীদাররা সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
স্কোপাসের তথ্যে আরও জানা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৯-২০ সালে গবেষণা খাতের জন্য যে বরাদ্দ করেছিল, তা মূল বাজেটের ১.১৫ শতাংশ। ২০১৮-১৯ সালে এ বরাদ্দ ছিল ৫ কোটি টাকা। পরে সংশোধনী বাজেটে তা ৫.২০ কোটি টাকায় বাড়ানো হয়।
ইউজিসির সর্বশেষ (২০১৯) বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক ৮৩৬ জন। যাদের প্রত্যেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ গবেষণা ভাতা পান। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সংখ্যা ২৮৪ জন, সহযোগী অধ্যাপক ১৭৮ জন, সহকারী অধ্যাপক ২১৬ জন এবং প্রভাষক ১৫৮ জন।
তবে ২০২০ সালে শিক্ষক অনুপাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার পরিমাণ প্রায় প্রতি দু’জনে একটি করে।
জাহাঙ্গীরনগরে গবেষণা দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে। স্কোপাসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫ সালে ২০৪টি, ২০১৬ সালে ১৮০টি, ২০১৭ সালে ১৯৯টি, ২০১৮ সালে ২২৮টি, ২০১৯ সালে ৩০১টি এবং ২০২০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪৭টি গবেষণা নিবন্ধ বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ হয়েছে।
যা গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। ফলে ২০২০ সালে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগরের অবস্থান চতুর্থ। তবে গবেষণা খাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য হারে এখনও বাড়েনি।
২০২০ সালে জাহাঙ্গীরনগরের গবেষকদের ৪৪৭টি গবেষণা নিবন্ধের মধ্যে প্রায় ৩৪৪টি (৭৮%) জার্নাল নিবন্ধ। বাকিগুলো কনফারেন্স পেপার (৮.৫%), রিভিউ আর্টিকেল (৫.৮%), লেটারস (৬.০%) এবং বুক চ্যাপ্টার (০.৪%) আকারে প্রকাশিত। গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশের ক্ষেত্রগুলো হলো মেডিসিন (১৩.৪%), কম্পিউটার সায়েন্স (৮.৮%), রসায়ন (৮.৪%), পরিবেশবিজ্ঞান (৭.১%), ইঞ্জিনিয়ারিং (৬.৩%), ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স (৬.৩%), পদার্থ (৬.২%), কৃষি (৫.৪%), বায়োকেমিস্ট্রি (৫.১%), সমাজবিজ্ঞান (৪.০%) এবং অন্যান্য (২৮.৯%)।
গবেষণায় আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় গবেষকদের সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান, চীন, সৌদি আরবের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূল অংশীদার ছিল। অন্যদিকে চিন্তা রিসার্চ বাংলাদেশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন প্রধান স্থানীয় অংশীদার ছিল। এছাড়া গবেষকরা ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে একাধিক গবেষণা নিবন্ধও প্রকাশ করেছেন।
এসব গবেষণা প্রকল্পগুলোর অর্থায়নে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় উভয় তহবিল সংস্থা জড়িত ছিল। জাতীয় অর্থায়নের সিংহভাগ এসেছে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে।
প্রকাশনাগুলো যেসব জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে মডেলিং আর্থ সিস্টেমস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড অ্যাডিকশন, হেলিয়ন, এশিয়ান জার্নাল অব সাইকিয়াট্রি, ফ্রন্টিয়ার্স ইন পাবলিক হেলথ, প্লাস ওয়ান, জার্নাল অব বায়োমলিকুলার স্ট্র্যাকচার অ্যান্ড ডায়নামিক এবং ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন উল্লেখযোগ্য।
জাহাঙ্গীরনগরের সেরা ১৫ গবেষকের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এ এ মামুন। ৩৬টি প্রকাশনা নিয়ে তিনি প্রথম স্থানে রয়েছেন। এ এম হক ১৯টি প্রকাশনা নিয়ে দ্বিতীয়; এফ আহমেদ এবং এম টি সিকদার ১৫টি করে প্রকাশনা নিয়ে তৃতীয়; এম এস কায়সার এবং এম এ উল্লা ১৩টি করে প্রকাশনা নিয়ে চতুর্থ; এম এম রহমান এবং বি সরকার ১২টি করে প্রকাশনা নিয়ে পঞ্চম; এস ই কবির, এ এ মামুন, এম এম রহমান এবং এম এম রহমান ১১টি করে প্রকাশনা নিয়ে ষষ্ঠ; এম এ হোসেন, এস হোসেন, এস ইসলাম, এম শাম্মী এবং এম এস উদ্দিন ১০টি করে প্রকাশনা নিয়ে সপ্তম স্থানে আছেন।
এদিকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭৬০টি প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম, ৫১০টি প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) দ্বিতীয়, ৪৫৬টি প্রকাশিত প্রবন্ধ নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় এবং ৪৩৭টি প্রবন্ধ প্রকাশ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।
গবেষণার সার্বিক বিষয়ে বিশিষ্ট পদার্থবিদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক এ এ মামুন সমকালকে বলেন, আমরা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এগিয়ে আছি। কেননা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলনায় আমাদের শিক্ষক সংখ্যা কম। এখানে অনেক শিক্ষক আছেন যারা গবেষণা করেন, কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে তা প্রকাশ করতে পারেন না। এছাড়া অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা বিদেশে পড়ালেখা করেন, তাই তারা সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নামেই গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
শিক্ষার্থীদের গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নের বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো শিক্ষার্থী যদি গবেষণায় ভালো করে এবং সঠিক মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সহযোগিতা চায়, তবে আমার বিশ্বাস প্রশাসন বিষয়টিকে প্রাধান্য দেবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে মাত্র সাতটি প্রকাশনার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রশাসনিক জটিলতা বা বিড়ম্বনা এর মূল কারণ। এ বিষয়টি প্রশাসনকে অবহিত করেছি ব্যাপারটি সহজ করার জন্য।
Discussion about this post