শিক্ষার আলো ডেস্ক
বহু বছর পরের কথাই ধরা যাক। বিজ্ঞানীদের কাছে খবর এসেছে—মঙ্গল গ্রহে প্রাণের সন্ধান পাওয়া গেছে। আর এই খবর পাঠিয়েছে লাল গ্রহটির বুকে ভেসে বেড়ানো ড্রোন—নির্ভীক। এই ড্রোনের নির্মাতা বাংলাদেশের টিম ইন্টারপ্ল্যানেটার ।
শুনতে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর মতো মনে হলেও নামগুলো ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ নেওয়া। সম্প্রতি মার্স সোসাইটি সাউথ এশিয়া আয়োজিত আইপিএএস চ্যালেঞ্জে অংশ নেয় বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দল। ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানেটারি অ্যারিয়াল সিস্টেম চ্যালেঞ্জ—আইপিএএস মূলত বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য মহাকাশ গবেষণায় ব্যবহৃত ড্রোন তৈরির প্রতিযোগিতা। এ বছরের আয়োজনের বিষয় ছিল ‘প্রোপেলিং এক্সপ্লোরেশন’ অর্থাৎ উদ্ভাবনে গতি আনা।
মঙ্গল গ্রহে গবেষণার কাজে ব্যবহার করা যাবে এমন ড্রোন তৈরির চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয় অংশগ্রহণকারীদের। সারা বিশ্ব থেকে ২৬টি দল অংশ নেয় এ বছরের আয়োজনে। কম্পিউটারের বিভিন্ন সিমুলেশনের সাহায্যে পরীক্ষিত নকশার ওপরে বানানো প্রতিবেদন জমা দিতে হয় তাঁদের। যা যাচাই-বাছাই শেষে বিচারকেরা ঘোষণা করেন সেরা দলের নাম। সেরা ১০ দলের তালিকায় অষ্টম স্থানে আছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) টিম ইন্টারপ্ল্যানেটার দল। পরের অবস্থান খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের। আরেকটু পেছনে, ১৬তম অবস্থানে আছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দল ব্র্যাকইউ কিলো ফাইট। র্যাঙ্কিংয়ে অষ্টম হলেও উদ্ভাবনে ‘সেরা’ খেতাব পেয়েছে টিম ইন্টারপ্ল্যানেটার। তাদের ড্রোনে থাকা বিশেষ ‘গ্যাস কম্প্রেসন সিস্টেম’ নজর কেড়েছে বিচারকদের।
বুয়েটের ইন্টারপ্ল্যানেটার দলে ছিলেন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল বিভাগের খন্দকার শিহাবুল হক, মো. রাসুল খান, কুশল রায়; যন্ত্রকৌশল বিভাগের নাজীব চৌধুরী, নাফিজ ইমতিয়াজ, রাফি বিন দস্তগীর, স্বরূপ চন্দ, অপূর্ব সরকার, মিসফাকুর রহমান, সৈয়দ তাওসিফ ইসলাম, মো. আমিন হক, অজয় কুমার সরকার, ইন্তেসার জাওয়াদ জায়গীরদার, ইয়ামিনুল হক, ইমন রায়, ফারসিয়া কাওসার চৌধুরী, এম আবরার মুহিত, আর কে বি এম রিজমি ও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এস এম সাকিফ সানি।
‘নির্ভীক’ নামের ড্রোনটি নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা বললেন মেকানিক্যাল টিমের দলনেতা নাজীব চৌধুরী। ‘আইপিএএস চ্যালেঞ্জে অংশ নিতে গিয়ে শুরুতেই আমাদের চিন্তা করতে হয়েছে মঙ্গলের আবহাওয়ার কথা। সেখানকার বাতাসের চাপ, আদ্রতা, অভিকর্ষের মান—সব মিলিয়ে এক ভিন্ন পরিবেশের জন্য ড্রোনের নকশা তৈরি করতে হয়েছে আমাদের। করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে যুক্ত থেকে সবাই বাসায় বসে কাজ করেছি। প্রায় দুই মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে আমরা নির্ভীক দাঁড় করাতে পেরেছি।’
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে নাসার নতুন রোভার পারসিভারেন্স পাঠানো হয় মঙ্গল গ্রহে। যার সঙ্গে পাঠানো হয় একটি ড্রোন—ইনজিনুইটি। মঙ্গল গ্রহের রুক্ষ আবহাওয়ায় মাটিতে ঘুরে ঘুরে অভিযান পরিচালনার সময় বাঁচাতে এমন ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করে নাসা। তাই সারা বিশ্বই এখনো এমন গবেষণাধর্মী ড্রোন তৈরি করার চেষ্টা করছে। আইপিএএস চ্যালেঞ্জে মূলত ইনজিনুইটি থেকে আরও উন্নত মানের ড্রোন তৈরিতে উৎসাহ দেওয়া হয়।
টিম ইন্টারপ্ল্যানেটারের উদ্ভাবিত ড্রোন নির্ভীক মঙ্গলের মাটিতে গবেষণায় সাহায্য করতে পারবে। এটির ভেতরে থাকা বিভিন্ন সেন্সর মঙ্গলের বায়ুতে থাকা নানা উপাদান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তা পাঠাতে পারবে নির্ধারিত রোভারে। এ কাজে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মঙ্গলের তাপমাত্রা। প্রায়-১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার বৈরী আবহাওয়াতেও গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা রেখে তৈরি করা হয়েছে নির্ভীক।
প্রতিযোগিতায় কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে? প্রশ্নের উত্তর দিলেন নির্ভীকের মূল কাঠামোর মধ্যভাগের নকশা প্রস্তুতকারী রাফি বিন দস্তগীর। ‘রোভার নিয়ে কাজ করলেও ড্রোন নিয়ে আমরা আগে কাজ করিনি। আমাদের দলের বেশির ভাগ সদস্যই স্নাতক দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। চারটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে কাজ করার জন্য দলের কাজ ভাগ করে নিয়েছিলাম আমরা।’ নির্ভীকের যান্ত্রিক নকশা সাজিয়েছেন স্বরূপ চন্দ।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলছিলেন দলনেতা খন্দকার শিহাবুল হক। ‘ড্রোন প্রযুক্তি কিন্তু শুধু ভিনগ্রহে অভিযানের জন্য নয়। আমাদের দেশের দুর্যোগকালীন অবস্থায় খাদ্য সরবরাহ, মানুষকে নিরাপদ স্থানে পথ দেখানো, উদ্ধার অভিযান চালানো, বিভিন্ন নিরাপত্তা মিশন পরিচালনা—এমন নানা কাজে ড্রোনের ব্যবহার হতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন কারখানাতে উৎপাদনের মাত্রা বাড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে রোবটিকস প্রযুক্তি। এসব ক্ষেত্রে আমাদের ভালো করার সুযোগ আছে।’
সামনে চোখ রেখে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের দলটি এখন এ বছরের ইউরোপীয় রোভার চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
Discussion about this post