নিজস্ব প্রতিবেদক
এখন থেকে কারিগরির ডিপ্লোমাধারীরাও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাবেন।এরইমধ্যে মন্ত্রণালয় সভা করে দেশের সব প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ভর্তির সুযোগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) নির্দেশ দিয়েছে।
আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের এ সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভর্তির সুযোগের সঙ্গে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স করা শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ক্রেডিট সমন্বয় করা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
ডিপ্লোমা পাস শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সুযোগ করে দিতে গত ১৮ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে করণীয় নির্ধারণ করতে একটি সভা হয়।
সভা সূত্রে জানা যায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বর্তমান সরকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় পাসকৃত শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। এ লক্ষ্যে ডিপ্লোমা পর্যায়ে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে পাসকৃত শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দেওয়ার জন্য পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা বিভাগকে অনুরোধ করেন। এ লক্ষ্যে বিভাগ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডকে মতামত দিতে অনুরোধ করে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের মতামতের ভিত্তিতেই সভার আয়োজন করা হয়।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মহসিন বলেন, দেশের কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র গাজীপুরে অবস্থিত সরকারি ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) বিএসসি-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে শিক্ষার সুযোগ পেয়ে থাকে। কিন্তু ইয়ার অব স্কুলিং বিবেচনায় ডিপ্লোমা পাস করা এ শিক্ষার্থীরা দেশের সব সরকারি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অধিকার রাখেন। কিন্তু সে সুযোগ থেকে তারা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। আমরা ইউজিসির কাছে ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছি। ক্রেডিট সমন্বয় করে দেশের অন্যান্য সরকারি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করার প্রস্তাবের এখনো কোনো সিদ্ধান্ত ইউজিসি আমাদের জানায়নি। আমরা তাদের (ইউজিসি) পদক্ষেপ নেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি।
যুগ্মসচিব (কারিগরি-২) সভায় জানান, ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর অধ্যায় (৫) এর বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার অনুচ্ছেদের ক্রমিক নম্বর (৬) অনুসারে ‘কারিগরি ডিপ্লোমা পর্যায়ে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করে ক্রেডিট সমন্বয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট স্নাতক পর্যায়ের উচ্চ শিক্ষা কোর্সে (ইঞ্জিনিয়ারিং, টেক্সটাইল, কৃষি ইত্যাদি) ভর্তির সুযোগ দেওয়া হবে’ উল্লেখ রয়েছে।
এ ছাড়াও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর অধ্যায় ৯ এর প্রকৌশল শিক্ষার অনুচ্ছেদের ক্রমিক নম্বর ৯ অনুসারে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী দেশের প্রকৌশল বিদ্যায়তনে যথা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চতর শিক্ষার জন্য যথাযোগ্য ক্রেডিট সমন্বয়ের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন বলে উল্লেখ রয়েছে।
অতিরিক্ত সচিব (কারিগরি) সভায় বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি বা সমমান। এসএসসির পর শিক্ষার্থীরা দুই বছর মেয়াদি কোর্স অর্থাৎ মোট ১২ বছরের স্কুলিং শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকেন; অপরদিকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের এসএসসির পর চার বছর মেয়াদি কোর্স অর্থাৎ ১৪ বছরের স্কুলিং শেষ করতে হয়। এ বিবেচনায় ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগের অধিকার রাখেন। এ বিষয়ে ইউজিসি জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারে।
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) এর প্রতিনিধি ড. মো. রাজু আহমেদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপ্লোমা পর্যায়ের পাসকৃত শিক্ষার্থীদের ভর্তির বিষয়ে ১৮ ক্রেডিট আওয়ার পর্যন্ত ওয়েভার দেওয়া হয়। এ বিষয়ে ইউজিসির নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে।
ইউজিসির সচিব সভায় জানান, ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে পাসকৃত শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দিলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তির ক্ষেত্রে এক ধরনের নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।
কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি বা সমমান। এসএসসির পর শিক্ষার্থীরা দুই বছর মেয়াদি কোর্স অর্থাৎ মোট ১২ বছরের স্কুলিং শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকেন; অপরদিকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের এসএসসির পর চার বছর মেয়াদি কোর্স অর্থাৎ ১৪ বছরের স্কুলিং সম্পন্ন হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে এইচএসসি/সমমান যা এসএসসি এর পর দুই বছর মেয়াদী কোর্স অর্থাৎ মোট ১২ বছরের স্কুলিং এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকে; অপরদিকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাক্রম এসএসসি এর পর চার বছর মেয়াদী কোর্স অর্থাৎ ১৪ বছরের স্কুলিং সম্পন্ন হয়।
তিনি বলেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে পাসকৃত শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তির বিষয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ উল্লেখ রয়েছে বিধায় এ বিষয়ে ইউজিসি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারে। ইউজিসির ভর্তি নীতিমালায় গুচ্ছপদ্ধতি ভর্তি প্রক্রিয়া এক ধরনের হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে পাসকৃত শিক্ষার্থীদের দেশের সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দেওয়া এবং একইরূপে ওয়েভার দেওয়া যৌক্তিক। এ বিষয়ে সভায় উপস্থিত সবাই একমত পোষণ করেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইউজিসিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
ইউজিসি সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. ফেরদৌস জামান এ বিষয়ে বলেন, ডিপ্লোমা পাস শিক্ষার্থীদের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়টি যৌক্তিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে সভা করতে বিলম্ব হচ্ছে। শিগগিরই সভা করে সমস্যা সমাধান করা হবে।
১৯০৮ সালে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে (বর্তমান বুয়েট) তিন বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রকৌশল শিক্ষার সূচনা হয়। বর্তমানে ৪৯টি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, একটি ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, সাতটি সরকারি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, ছয়টি সরকারি মেরিন ইনস্টিটিউট, ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ সাড়ে চার শতাধিক বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি দেওয়া হয়।
প্রতি বছর এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর সোয়া লাখ শিক্ষার্থী ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। তারা ডিপ্লোমা পাস করলেও উচ্চশিক্ষা তথা বিএসসি কোর্স করার সুযোগ পান না। গাজীপুরে অবস্থিত ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়।
কয়েকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ডিপ্লোমা পাস করা শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ দিলেও এইচএসসি সিলেবাসের আলোকে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন করায় ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হন। এ সুযোগ নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ডিপ্লোমা পাস করা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে। তবে অনেক অভিভাবকের পক্ষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সক্ষমতা নেই। ফলে ডিপ্লোমা পাস শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। অপরদিকে সরকার উচ্চশিক্ষার সুযোগ না বাড়িয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি দেওয়ার জন্য নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করছে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ জানুয়ারি শিক্ষা সংবাদ সম্মেলন করে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান বলেন, গাজীপুরের ডুয়েটে ডিপ্লোমা করা শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও চারটি জেলায় (ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ, নড়াইল ও খাগড়াছড়ি) সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নির্মিত হচ্ছে। সেখানে ডিপ্লোমা পাস করা প্রকৌশলীদের থেকে ৫০ শতাংশ এবং বাকি ৫০ শতাংশ সরাসরি ভর্তির সুযোগ পাবেন। এসব প্রতিষ্ঠান বুয়েটের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। এর ফলে অনেক ডিপ্লোমা পাস করা প্রকৌশলী বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন। প্রথম পর্যায়ে চারটি বিষয়ে ৩৬০ জন এবং পরবর্তীতে বিষয় বাড়লে সেখানে হাজারের বেশি ডিপ্লোমা পাস করা প্রকৌশলীদের ভর্তির সুযোগ থাকবে।
Discussion about this post