সাব্বির নেওয়াজ
কভিড-১৯-এর টিকা পেতে সুরক্ষা অ্যাপে তথ্য নিবন্ধন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। সবচেয়ে বেশি জটিলতা হচ্ছে ১৬ ডিজিটের পুরোনো জন্মনিবন্ধন সনদধারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে।
কারণ বর্তমানে জন্মনিবন্ধন সনদ ১৭ ডিজিটের। তাই আইসিটি বিভাগের সুরক্ষা অ্যাপসে নিবন্ধন করতে গিয়ে ১৬ ডিজিটের জন্মনিবন্ধন নম্বর দিলে আরও একটি সংখ্যা চাওয়া হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানরা বিষয়টি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে (মাউশি) জানিয়েছেন।
মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, পুরোনো জন্মনিবন্ধনধারী শিক্ষার্থীদের টিকা নিবন্ধনে ভোগান্তির কথা জানতে পেরেছি। এ বিষয়ে আজই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও আইসিটি বিভাগকে মাউশি থেকে চিঠি দিয়ে ১৬ ডিজিটের জন্মনিবন্ধনের তথ্যাবলিও রেজিস্ট্রেশন সফটওয়্যারের সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করতে অনুরোধ জানিয়েছি। আশা করছি, এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী আনিকা তাবাসসুম পুরোনো জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে চেষ্টা করেও টিকার নিবন্ধন গত বুধ ও বৃহস্পতিবার করাতে পারেনি। তার সহপাঠীরা মিরপুর-১৩ নম্বরে স্কলাসটিকায় টিকা নিচ্ছে। একইভাবে উত্তরার উত্তরখান কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র দীপ্র হাসানও টিকার নিবন্ধন করতে পারেনি। তার কলেজের স্টাফ নিবন্ধন করতে ব্যর্থ হলে দু’জন শিক্ষক দায়িত্ব নেন। তারাও ব্যর্থ হয়েছেন।
অফিস অব রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় বর্তমানে কোনো শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন সম্পন্ন করছে। আর যারা ১৮ বছরের ওপরে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) আছে। এই দুই স্তরে পরিচয় ও শনাক্তের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আগে অভিভাবকরা নিজ গ্রামের স্থানীয় ইউপি কার্যালয় থেকে সন্তানের যে জন্মসনদ নিতেন, তা হাতে লিখে দেওয়া হতো। আবার গ্রামগঞ্জের বহু অভিভাবকই সন্তানের জন্মনিবন্ধন আগে করাননি। কেউ কেউ শহরে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর সময় হাতে লেখা ১৬ ডিজিটের জন্মসনদই জমা দিয়েছিলেন। বর্তমানে টিকার প্রয়োজনে ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে তারা জেনেছেন, কোনো শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে হলে আগে তার বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন করাতে হবে। তিনটি জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে অভিভাবকদের বাড়তি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আবার অনেক অভিভাবক আগে জন্মনিবন্ধন করিয়ে থাকলেও হয়তো নানা তথ্যে ভুল রয়ে গিয়েছিল। তাদেরও আবার অতিরিক্ত অর্থ ও সময় ব্যয় করে জন্মনিবন্ধন করতে হয়েছে বা হচ্ছে। সব মিলিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের।
এসব সমস্যার বিষয়ে ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার আবদুল মজিদ গতকাল রোববার বলেন, কয়েকটি কারণে টিকার নিবন্ধনে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। পুরোনো জন্মনিবন্ধন সনদের তথ্য সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করতে মাউশি চিঠি দিয়েছে। কারণ জন্মনিবন্ধনের তথ্য আগে থেকে এন্ট্রি না থাকলে ম্যাচ করে না। আর সুরক্ষা অ্যাপসে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ডাটা আপ করতে গিয়ে শিক্ষকরা কিছু ভুল করেছেন। তারা অনেকে এক্সেল শিটে কাজ করতে এক্সপার্ট নন, সাধারণ ওয়ার্ডে কাজ করতে অভ্যস্ত। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে দেওয়া এক্সেল শিটে ফরম্যাট করে দেওয়াই ছিল। অনেক শিক্ষক না বুঝে ফরম্যাট ভেঙেছেন। যে কারণে তারা আর তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি।
প্রসঙ্গত, যে আটটি কেন্দ্রে একযোগে টিকাদান কার্যক্রম চলছে সেগুলো হলো- মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, হার্ডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুল (ভাটারা), সাউথ পয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (মালিবাগ), চিটাগং গ্রামার স্কুল (বনানী), কাকলি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ (ধানমন্ডি), ঢাকা কমার্স কলেজ (চিড়িয়াখানা রোড), স্কলাসস্টিকা (মিরপুর-১৩) ও সাউথ ব্রিজ স্কুল (উত্তরা)।
আরও যত সমস্যা : অব্যবস্থাপনার কারণে টিকাদান কেন্দ্রগুলোয় জটলা সৃষ্টি হচ্ছে ও স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হচ্ছে। কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যাওয়া অভিভাবকদের বসার কোনো ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। করোনা ঝুঁকি নিয়ে স্কুল গেটেই থাকতে হচ্ছে তাদের। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার ধানমন্ডির কাকলি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে টিকাদান শুরুর কিছুক্ষণ পর কার্ড স্ক্যানিং মেশিনে কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয়। ফলে শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রের ভেতরে পাঠিয়ে অভিভাবকদের রোদে ঠাঁই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে।
তবে কাকলি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ দীন মোহাম্মদ খান অভিযোগ করেন, অভিভাবকরা টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা না করে শুধু অভিযোগ করছেন। গেটের সামনে হাজার হাজার অতি উৎসুক অভিভাবক ভিড় করছেন। বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যমের অভিভাবকরা ভেতরে প্রবেশের বায়না ধরছেন। তারা বুঝতে চান না তাতে শিক্ষার্থীদেরই টিকাদানে বিশৃঙ্খলা হবে।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম বলেন, শৃঙ্খলা বজায় রাখতেই তাদের গলদঘর্ম হতে হচ্ছে বেশি। সব অভিভাবকই তার সন্তানের টিকা আগে দিয়ে দিতে চাপ দেন।
বনানীর চিটাগং গ্রামার স্কুল টিকাকেন্দ্রে গত মঙ্গল ও বুধবার টিকা নিতে আসা কয়েকশ শিক্ষার্থী দীর্ঘ অপেক্ষার পর টিকা না পেয়েই ফিরে যায়। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের অনেকে স্কুলের ফটকে ধাক্কাধাক্কিও করে।
টিকা পেয়েছে ৮৫ হাজার শিক্ষার্থী : গত শনিবার পর্যন্ত ৬ দিনে ৮৫ হাজার ছাত্রছাত্রীর টিকা দেওয়া শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার আবদুল মজিদ। তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪৯ হাজার ও গত দুই দিনে আরও ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী টিকা পেয়েছে। তিনি জানান, তাদের হিসাবে ঢাকা শহরে মোট ৬৩৫টি (ইআইআইএন নম্বরধারী) স্কুল ও কলেজ রয়েছে। এগুলোতে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এ পর্যন্ত ৩ লাখ ৬০ হাজার ছাত্রছাত্রীর তথ্য মিলেছে যারা রেজিস্ট্রেশন করেছে অথবা নিবন্ধনের চেষ্টা করছে।
বন্ধ হবে দুটি কেন্দ্র : আসন্ন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার কারণে টিকাদানের আটটি কেন্দ্রের মধ্যে দুটি কেন্দ্র ১৩ নভেম্বরের মধ্যেই বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ দুটি কেন্দ্রে পরীক্ষার কেন্দ্র হবে। ঢাকা কমার্স কলেজ কেন্দ্রে এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র ও মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে এসএসসি ও এইচএসসি দুটি পরীক্ষারই কেন্দ্র রয়েছে।
মাউশির উপপরিচালক (মাধ্যমিক) মো. আজিজ উদ্দিন বলেন, এ দুটি প্রতিষ্ঠানে টিকাকেন্দ্র বন্ধ করা হলেও আশপাশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিকল্প টিকা কেন্দ্র চালু করা হবে। রাজধানীতে মোট টিকার ভেন্যু আটটিই রাখা হবে।
Discussion about this post