আতিক হাসান শুভ
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রেক্ষাপটে নতুন ভাড়া নির্ধারণের পর গণপরিবহন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। নির্ধারিত ভাড়ার চাইতেও বেশি ভাড়া নেওয়া, গ্যাসে চালিত গাড়িতেও বর্ধিত ভাড়া নেওয়া, সিটিং সার্ভিস কিংবা ওয়েবিলের নামে বাড়তি ভাড়া নেওয়া; আর এসব অভিযোগ নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের বাহাস এখনও নিয়মিত। এরই মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে সড়কে নেমেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এসব বিচ্ছিন্ন আন্দোলনের যোগসূত্র না থাকলেও সকলের দাবি প্রায় একইরকম। তার মধ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘হাফ ভাড়া’ নির্ধারণ করার দাবিই প্রধান।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, করোনাকালে পরিবারের উপার্জন কমার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পকেট খরচও কমেছে। নতুন করে বাস ভাড়া বাড়ায় তাদের জন্য বিষয়টি ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য নতুন করে ‘দানা বাঁধছে’ আন্দোলন। এরই মধ্যে গেল কয়েকদিনে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ভাঙচুর ও সড়ক অবরোধের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
আন্দোলনগুলোতে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাসের স্টাফদের আচরণ। বিভিন্ন স্থানে অসৌজন্যমূলক আচরণ, গায়ে হাত তোলা থেকে শুরু করে যৌন হয়রানির মতো অভিযোগ উঠছে। এমনকি গতকাল রবিবার রাজধানীর বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক শিক্ষার্থী হাফ ভাড়া দিতে চাওয়ায় বাসের কন্ট্রাক্টর এক ছাত্রীকে ‘অকথ্য ভাষায়’ গালাগালসহ ধর্ষণের হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত সপ্তাহে (১৫ নভেম্বর) রাজধানীর রামপুরা বিটিভি ভবনের সামনে রাইদা পরিবহনের একটি বাস থেকে ভাড়া নিয়ে বিতণ্ডায় এক শিক্ষার্থীকে ‘ঘাড় ধাক্কা দিয়ে’ নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পরে শিক্ষার্থীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওই রুটের অন্তত অর্ধশত বাস আটক করে রাখে। এক পর্যায়ে পুলিশের মধ্যস্ততায় ওই পরিবহনে ‘হাফ ভাড়া’ নিতে রাজি হলে বিষয়টি সুরাহা হয়।
গত ১৭ নভেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সাথে বিহঙ্গ বাসের হেল্পার অসৌজন্যমূলক আচরণ করার কারণে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে বাস ভাঙচুর করেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতারও করা হয়। পরবর্তী সময়ে জবির প্রক্টোরিয়াল টিমের অনুরোধ তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৮ নভেম্বর তিতুমীর কলেজের ৪ শিক্ষার্থীকে মারধরের প্রতিবাদে শনিবার ঢাকা কলেজের সামনে বাস ভাঙচুর করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী।
গতকাল বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আন্দোলনে নেমেছিলেন পুরান ঢাকা এলাকার আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। কথা তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা বলেন, হাফ পাস শিক্ষার্থীদের আবদার নয়, অধিকার। প্রত্যেকটি বাসে শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। হাফ পাসের জন্য শিক্ষার্থীরা যেন শিক্ষার্থীরা হয়রানির শিকার না হয় সে জন্য প্রশাসনে সহযোগিতা চেয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
উম্মে হাবিবা অনু নামে কবি নজরুল সরকারি কলেজের এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, তার যাতায়াতের রুটে ভিক্টর ক্লাসিক নামের বাসে হাফ ভাড়া নেওয়া হয় না। এমনকি স্টুডেন্ট বুঝতে পারলে মাঝেমধ্যে তুলতেও চান না বাসের স্টাফরা।
একই অভিযোগ করেন ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী তামান্না আক্তার। তিনি বলেন, শিক্ষার্থী দেখলে সাভার পরিবহন মাঝেমধ্যে গেইট লাগিয়ে দেয়, যার কারণে কলেজে সঠিক সময়ে উপস্থিত হতে পারি না। আর তারা কোনোভাবেই হাফ ভাড়া নেয় না। হাফ ভাড়ার কথা বললে ওরা বলে- এটা সরকারি গাড়ি না। এখানে হাফ ভাড়া নেওয়ার নিয়ম নেই।
সাবরিনা নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আজমেরী গ্লোরি অথবা বিহঙ্গ বাসের হেল্পারদের হাফ ভাড়া নিতে বললে তারা কোনোভাবেই হাফ ভাড়া নেয় না, আজেবাজে ব্যবহার করে।
সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলাম বলেন, রজনীগন্ধা, শ্রাবণ, সুপ্রভাত কোনোবাসেই শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নেয় না। প্রতিনিয়ত ক্যাম্পাসে আসতে আমাদের অনেক টাকা ভাড়া লেগে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নেওয়ার নির্দেশনা থাকে সকল শিক্ষার্থীদের উপকার হতো।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাসের স্টাফদের এই দ্বন্দ্বের কথা জানে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরাও। তারা বিষয়টি সুরাহার জন্য উদ্যোগও নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। কবি নজরুল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আমেনা বেগম বলেন, পুরান ঢাকায় শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিগগিরই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাস মালিক সমিতির আলোচনা হবে। শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিশ্চয়তাই আমরা আমাদের সর্বোচ্চটুকু করবো।
তবে অনেক সময় শিক্ষার্থী না হয়েও অনেকে হাফ ভাড়ার সুবিধা নিতে চায় বলেও জানান তিনি। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড দেখানোর প্রয়োজন হলে, তা দেখানোর পরামর্শ দিয়েছেন এ শিক্ষক। বাসের হেল্পার হাফ ভাড়া না নিলে শিক্ষার্থীদের ঝামেলায় না জড়িয়ে বিষয়টি নিকটবর্তী পুলিশ ফাঁড়ি অথবা প্রশাসনকে জানানোরও অনুরোধ করেন অধ্যাপক আমেনা বেগম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভিক্টর ক্লাসিক বাসের এক চালক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিলে আমাদের পোষায় না। তারপরও আমরা মাঝেমধ্যে হাফ ভাড়া নেই। আমাদেরও ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন আছে। ওরাও পড়াশোনা করে। কিন্তু সবার থেকে হাফ ভাড়া নিতে গেলে আমাদের ডিজেলের টাকাইতো ওঠে না।
দিন শেষে বাসের মালিককে ৩ হাজার টাকার বেশি জমা দিতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মালিকের ভাড়া, তেল ছাড়াও রাস্তায় পুলিশ, শ্রমিক নেতাসহ অনেকরেই টাকা দেওয়া লাগে। (ট্রাফিক পুলিশ) সার্জেন্ট ধরলেই মামলা দেওয়ার ভয় দেখায়, ওদেরও কিছু দেওয়া লাগে।
মালিকপক্ষ বাসের দৈনিক জমা কমিয়ে দিলে হাফ ভাড়া নিতে স্টাফদের কোনও অসুবিধা নেই বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহর সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আগে বেসরকারি বাসে হাফ ভাড়া নেওয়া হতো। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে প্রতিটি বাস থেকে হাফ ভাড়া নিতে গেলে মালিকপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। হাফ ভাড়া শুধু সরকারি বাসগুলোতে (বিআরটিসি) নেওয়ার সুযোগ আছে। তাছাড়া সরকার যদি বেসরকারি বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তুকি দেয় তাহলে হাফ ভাড়া নেওয়া সম্ভব হবে। সৌজন্যে-বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post