শিক্ষার আলো ডেস্ক
৩ মার্চ ছিল বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস। বিশ্ব জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৮তম অধিবেশনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদের বাণিজ্য সম্মেলনে ৩ মার্চকে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস ঘোষণা করা হয়। ২০১৪ সালে প্রথম এ দিবসটি পালন করা হয়।
এ বছরের প্রতিপাদ্য হিসেবে এসেছে ‘রিকোভারিং কি স্পিশিস ফর ইকোসিস্টেম রেস্টরেশন’। যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করা হয়েছে, ‘বিপন্ন বন্যপ্রাণী রক্ষা করি, প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসি’।
দিবসটির প্রাক্কালে দেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও গবেষণায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন এমন তিন পথিকৃত অধ্যাপকের সঙ্গে তাদের চলমান গবেষণা কর্মের বিষয়ে কথা বলে জাগো নিউজ। তারা সবাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক।
স্বনামধন্য এ তিনজন অধ্যাপক হলেন- জাবিতে পাখি মেলার অন্যতম কর্ণধার অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান, প্রজাপতি মেলা নামক অভিনব মেলার সফল আয়োজক অধ্যাপক ড. মো. মনোয়ার হোসেন এবং সুন্দরবনের বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ।
অধ্যাপক আজিজ ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশের সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা, বিবর্তন ও সংরক্ষণ জেনেটিক্সের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ড. আজিজ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিপন্ন প্রজাতি এবং তাদের বসবাসের অঞ্চলের ওপর কাজ করে আসছেন। দেশীয় বাঘ, এশিয়া অঞ্চলের হাতি, ছোট আকৃতির সর্বভুক যেমন উদবিড়াল, দেশীয় শিয়াল, বাদুড় এবং ইঁদুর প্রভৃতি প্রাণী নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। অতি সম্প্রতি ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং এবং ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের বাঘের সংখ্যা গণনা এবং ধারণক্ষমতা নিয়ে যুগান্তকারী এক ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন এ প্রাণীবিদ। এছাড়াও গঙ্গা নদীর ডলফিন এবং ইরাবতি ডলফিন নিয়েও তিনি কাজ করেছেন।
এ বছরের বন্যপ্রাণী দিবসের প্রাক্কালে ড. আব্দুল আজিজ তার চলমান গবেষণা কর্ম নিয়ে বলেন, সুন্দরবনে বাঘ নিয়ে অনেক গবেষণাই হয়েছে। কিন্তু বাঘ যেসব শিকারের ওপর নির্ভরশীল তাদের সম্পর্কে তেমন গভীর তথ্য-উপাত্ত জানা নেই। তাই এই বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। তিন বছর মেয়াদী প্রকল্পটি জার্মানির একটি ব্যাংক কেএফডব্লিউ’র অর্থায়নে চলবে। এ তিন বছরে আমরা দেখব সুন্দরবনে হরিণ এবং বুনো শুকরের সংখ্যা কত।’
তিনি আরও বলেন, যেহেতু সুন্দরবনে বাঘের ৭৯ শতাংশ খাবার হরিণ এবং ১১ শতাংশ খাবার আসে বুনো শুকর থেকে তাই বাঘের সংখ্যা এবং ঘনত্ব জানতেও এ গবেষণা কাজে দেবে। এই কাজের জন্য আমরা পুরো সুন্দরবনকে ৬৫টি স্যাম্পল ইউনিটে ভাগ করেছি। প্রতিটি স্যাম্পল ইউনিটকে তিন থেকে ৯টি প্লটে ভাগ করা হয়েছে তার প্রতিটির আয়তন দুইশ বর্গ মিটার। এরকম প্লট আছে ৩১০টির ওপরে। এসব প্লট থেকে হরিণ এবং শুকরের বিষ্ঠা পুরোপুরি পরিষ্কার করা হয়। একটা হরিণ এক দিনে কতবার মলত্যাগ করে সে হারের ওপর ভিত্তি করে এক মাসে কতগুলো হরিণ এবং শুকরের মলের সংখ্যা (প্যালেট) এইসব প্লটে পাওয়া যায় সে তথ্য নির্ধারণ করে দেবে হরিণ এবং শুকর সংখ্যা। ২০০৯ সালে সুন্দরবনে প্রথম প্যালেট গণনা শুরু হলেও তেমন সফলভাবে তা শেষ হয়নি। তাই এই গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল উঠে আসবে বলে আশাবাদী এই গবেষক।
প্রাণী সংরক্ষণে ও গবেষণায় নিয়োজিত আরেক অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। ২০ বছর ধরে কাজ করছেন বন্যপ্রাণী বাস্তুসংস্থান, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ নিয়ে। এসব বিষয়ে ছয়টি বইও লিখেছেন।
পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন, জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ ও প্রজাতি ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি দেশ-বিদেশের অনেক সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছেন। দেশে বহুল আলোচিত ‘পাখি মেলা’র অন্যতম কর্ণধার ড. মো. কামরুল হাসান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা পরিযায়ী পাখি নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন।
চলমান গবেষণা কর্ম নিয়ে অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান বলেন, মিরসরাইয়ের বারৈয়ঢালা ন্যাশনাল পার্কে বন্যপ্রাণীর জীববৈচিত্র নিয়ে কাজ করছি। বিশেষ করে এখানকার বন্যপ্রাণীর উপর ট্যুরিজম, কৃষি এবং নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে কী প্রভাব তা জানতেই এই গবেষণা। গত বছরের অক্টোবর মাসে এ গবেষণাটি শুরু করি এবং তা চলবে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত। এই গবেষণার মাধ্যমে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে অজানা কিছু তথ্য উঠে আসবে বলে আশাবাদী এই অধ্যাপক।
অপরদিকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে নিরলস কাজ করে আসছেন অপর গবেষক অধ্যাপক মো. মনোয়ার হোসেন। তিনি ২০০৭ সালে জাপানের কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার গবেষণা পতঙ্গের ট্যাক্সোনোমি, ইকোলজি এবং সংরক্ষণ নিয়ে। প্রজাপতি নিয়ে তার যৌথ প্রকাশনা ‘বাটারঢফ্লাই অব বাংলাদেশ; এ পিকটোরিয়াল হ্যান্ডবুক’ দেশের প্রাণিবিদ্যার ক্ষেত্রে এক অনবদ্য সৃষ্টি। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজাপতি পার্ক এবং রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা। ২০১০ সাল থেকে প্রাণী সংরক্ষণে তরুণ প্রজন্মকে আরো সচেতন করতে তিনি প্রজাপতি মেলা নামে এক অভিনব মেলার কারিগর হিসেবে কাজ করে আসছেন।
প্রাণি গবেষণা ও সংরক্ষণ বিষয়ে অধ্যাপক মো. মনোয়ার হোসেন তার চলমান কাজের বিষয়ে বলেন, সারা দেশের বন্যপ্রাণীর ডিএনএ বার কোডিং নিয়ে কাজ করছি। বিশেষ করে মলিক্যুলার শনাক্তকরণের কাজটি। বিশ্ব ব্যাংক এবং বনবিভাগের অর্থায়নে পরিচালিত এ গবেষণার ফলাফল উঠে এলে দেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় এ তথ্য অনেক কাজে লাগবে।সৌজন্যে-জাগো নিউজ
Discussion about this post