সিরাজুজ্জামান
বাংলাদেশে এ সেক্টরে ঠিক কতজন কাজ করেন তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু তাতে কী যায় আসে। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে ঘরে বসেই দেশের ও বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে কার্যাদেশ নিয়ে কাজ করছেন তারা। যেহেতু নিজের ঘরে বসেই কাজ করা যায়, ফলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী এ পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সব বয়সী নারী-পুরুষই করতে পারছেন কাজ। শুধু দরকার এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও নিবেদিত প্রাণ কর্মী।
বলা হচ্ছে ফ্রিল্যান্সারদের কথা। বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল শহর যশোর ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনা মহামারিতে সময় নষ্ট না করে সরকারের লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের (এলইডিপি) আওতায় অনলাইনে প্রশিক্ষণ নিয়েই তারা এখন উপার্জন করছেন। তবে এ খাতে কিছু সমস্যার কথাও তুলে ধরেছেন তারা।
বাংলাদেশের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ফ্রিল্যান্সিং পেশার সঙ্গে যুক্ত বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড। সংস্থাটির মতে, তারা বছরে ১০ কোটি ডলার বা ৮৫০ কোটি টাকা আয় করছেন। ২০১১ সালে বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা মাত্র ২০ হাজার ছিল জানিয়ে সংস্থাটি বলেছে, উন্নত দেশগুলো তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে যে মাত্রায় এগোচ্ছে, বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো সে তুলনায় পারছে না। ডিজিটাল ইকোনমি রিপোর্ট ২০১৯ প্রকাশ করে এ তথ্য তুলে ধরেছে আঙ্কটাড। তবে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে অন্তত ছয় লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এ পেশার সঙ্গে জড়িত।
এবিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জাগো নিউজকে বলেন, প্রণোদনা পেলে ২০২৫ সাল নাগাদ ফ্রিল্যান্সিং থেকেই বছরে আসবে নয় হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সালের মধ্যে দেশে ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা ১০ লাখে উন্নীত করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশে আজ ডিজিটাল দেশ।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ফ্রিল্যান্সার উদ্যোক্তাদের একই প্ল্যাটফর্মে এনে তাদের পেশার স্বীকৃতি দেওয়ার লক্ষ্যে আইডি কার্ড দেওয়ার উদ্যোগ নেন। তারা এখন নিবন্ধনের আওতায় এসেছেন। ফলে নগদ সহায়তা দেওয়া হলে ফ্রিল্যান্সাররা আরও উৎসাহী হয়ে কাজ করবেন বলে মনে করেন পলক।
তিনি বলেন, শ্রমনির্ভর অর্থনীতি থেকে মেধা ও প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির দিকে দেশকে এগিয়ে নিতে ফ্রিল্যান্সাররা আমাদের মূল কারিগর। ফ্রিল্যান্সারদের আপস্কেলিংয়ে সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।
যশোর জেলার লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের গ্রাফিক্স ডিজাইনার কোর্সের প্রশিক্ষক নুরুন নাহার লীনা জাগো নিউজকে বলেন, গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তিনটি ক্যাটাগরিতে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। সেটা হলো গ্রাফিক্স ডিজাইনার, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং ওয়েব ডিজাইনার ডেভেলপ। এখন পর্যন্ত আমাদের গ্রাফিক্সের ২০টি, ওয়েব ডিজাইনের ১৪টি এবং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ওপর ১৫টি কোর্স সম্পন্ন শেষ হয়েছে। প্রথমটি ছিল আমাদের ৫০ দিনব্যাপী ২০০ ঘণ্টা ট্রেনিং। পরে ছয় মাসের ট্রেনিং করিয়েছি।
তিনি বলেন, আমাদের অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা সফলভাবে ফ্রিলান্সিং করছেন এবং নিজেদের মতো করে উপার্জন করছেন। শিক্ষার্থীরা করোনাকালীন সুযোগ খুঁজছিলেন কীভাবে এই সময় কাজে লাগানো যায়। বিশেষ করে নারীরা এগিয়ে এসেছেন। তারাও ভালো করছেন। অনেকের প্রয়োজনীয় উপকরণসহ নানা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তারা চেষ্টা করেছেন এবং নিজেকে গড়ে তুলছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে নুরুন নাহার লীনা বলেন, আমাদের ক্লাস করতে গিয়ে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। জুমের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়ার সময় সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যারা গ্রামে থাকেন তাদের সমস্যা হয়েছে। দেখা গেছে অনেকের ওয়াইফাই সংযোগ নেই। তাদের মোবাইল ডাটা কিনে ক্লাস করতে হয়েছে। এই খরচ অনেকের কাছে একটা সমস্যা। এ বিষয়গুলো যদি আরেকটু নজর দেওয়া যায় তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভালো করা সম্ভব।
তিনি বলেন, মোবাইলের ডাটার গতি এখনো অনেক কম। তবে মোবাইল ডাটার চার্জ অনেক বেশি। ফলে গ্রামীণ এলাকায় যারা কাজ করেন তাদের খরচ বেড়ে যায়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করা শারমিন আক্তার শান্তা জাগো নিউজকে বলেন, মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর বেশ কিছুদিন বসে ছিলাম। এরপর একটা চাকরি হয়েছিল। সেটার পোস্টিং ছিল মোংলা। নিরাপত্তা এবং আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং হওয়ায় চাকরিটা আর করা হয়নি। তখন আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে এ বিষয়ে জানতে পারি। এরপর গ্রাফিক ডিজাইন বিষয়ে কোর্স করি। কোর্স শেষে বিজনেস কার্ড ডিজাইন, লোগো ডিজাইন, মেনু কার্ড ডিজাইন- এ ধরনের কাজ করি। এভাবে আমার ওই সময় যাত্রা শুরু। এরপর গ্রাফিক ডিজাইনের ওপর কাজ শুরু করি। আমাদের বেশিরভাগ বায়ার বিদেশি।
তিনি বলেন, এই কাজ করার পর জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কারণ বিদেশি যখন একটি বায়ারের কাছ থেকে ডলার আসে তখন তো একটা অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে।
এ ধরনের ফ্রিল্যান্সিং কাজ নারীদের জন্য অনেক সুবিধাজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় মেয়েরা বাইরে চাকরি করতে গেলে তাকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন- রাত করে বাড়ি ফেরা যাবে না। বিবাহিত হলে শ্বশুরবাড়ি থেকেও তার প্রবলেম হয়। এ ধরনের নানা সমস্যা। সে হিসেবে ঘরে বসে যখন আমি একটা কাজ করছি, সেটা থেকে যখন আমার টাকা আসে, পরিবারকে আর্থিক সাপোর্ট দিতে পারছি- সেটা অন্য রকম অনুভূতি।
শেখ আবু উবাইদা নামে এক ফ্রিল্যান্সার জাগো নিউজকে বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে যখন করোনার প্রকোপ ছিল, সে সময় ঘরে বসেই একটি পোস্ট দেখতে পাই ফেসবুকে। এর আগে থেকেই গ্রাফিক ডিজাইনের প্রতি আমার প্রবল আকর্ষণ ছিল। সরকারি এই কোর্স দেখে নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি। কোর্স শেষ করে দুই মাসের মাথায় আমি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জয়ী হই। এরপর কাজ শুরু করি।
এছাড়া অনলাইন মাল্টিপ্লাস থেকে মাসে ৪০০ ডলার আয় হয়। অফলাইনে যে মার্কেটগুলো রয়েছে- যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এগুলোতে বাংলাদেশিদের হয়ে কাজ করি এবং সফল হই। এখন ঢাকার একটি কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত আছি। এছাড়া বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ কোম্পানি রংপুর কেমিক্যাল লিমিটেডের সঙ্গে কাজ করছি। যতগুলো কাজ করি আমি ঘরে বসেই করি।
প্রজ্ঞা পৃথিবী নামে আরেক ফ্রিল্যান্সার জাগো নিউজকে বলেন, আমি যশোরের মেয়ে। এলইডিপি রেজিস্ট্রেশন করার পর থেকেই দুই বছর ধরে ফ্রিল্যান্সিং করছি। এভাবে অনলাইন ও অফলাইনে আয় করছি। বিবাহিত নারী হিসেবে এ কাজটা আমার জন্য সুবিধাজন। ঘরে বসেই করতে পারছি।
ফজলে রাব্বী নামে আরেক কর্মী জাগো নিউজকে বলেন, করোনাকালীন যখন ঘরবন্দি ছিলাম তখন ফেসবুকে লার্নিং অ্যান্ড আর্নিংয়ের পোস্ট দেখতে পাই। আমি একজন গ্রাফিকস ডিজাইনার। এই কোর্সটা হয়েছিল জুম প্লাটফর্মে। ট্রেইনার এবং আমার প্রচেষ্টার ফলে দুই মাসের মধ্যে freelancer.com থেকে আয় শুরু করি। প্রথম কাজটা ব্রাজিলের ছিল। এর আগে বিভিন্ন কাজের জন্য আমাকে বাসা থেকে টাকা নিতে হতো, কিন্তু এখন আমি নিজেই আয় করতে পারছি।
Discussion about this post