অনলাইন ডেস্ক
একটা সময় ছিল যখন মাইলের পর মাইল পেরিয়ে দূর-দূরান্তে যেতে হতো শিক্ষা লাভের জন্য। কিন্তু বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে সেটি সহজ হয়ে গেছে। বিভিন্ন ই-লার্নিং প্লাটফর্মের মাধ্যমে ঘরে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষা লাভের পাশাপাশি নানা দক্ষতা অর্জন করা যাচ্ছে। সম্ভাবনাময় এ সেক্টরে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ‘বঙ্গ একাডেমি’। অনলাইনভিত্তিক এ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা জুবায়ের হোসেন।
আপনার ছোটবেলা নিয়ে কিছু বলুন—
আমার ছোটবেলা কেটেছে গোপালগঞ্জের ছোট্ট একটি গ্রামে। এরপর খুলনায় এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করি। এরপর ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হই। ছোট বয়স থেকে প্রোগ্রামিং শিখি। অনলাইনে কিংবা সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে যতটুকু সুযোগ পেতাম, চেষ্টা করতাম। আমার প্রোগ্রামিং নিয়ে জানার পরিধি দেখে আজিমপুরে একটি ট্রেনিং সেন্টার ‘জাতীয় যুব উন্নয়ন কেন্দ্রে’ ট্রেইনার হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়। সেখানে আমি সি প্রোগ্রামিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে ক্লাস নিতাম। এভাবেই আমার পথচলা শুরু হয়।
অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কীভাবে যাত্রা শুরু করলেন?
আমার বয়স যখন ১৫-১৬ তখন আমি আমার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করি। বিভিন্ন ক্লাইন্টের টুকটাক কাজ নিতাম। ছোট একটা টিম তৈরি করে ফেললাম। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাজ করার সুযোগ হয়েছে, ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউয়ের জন্য কাজ করেছি। আইসিটি ডিভিশন থেকে পরপর দুবার ফান্ড পেয়েছি। দেশে-বিদেশে অনেক ক্লায়েন্ট যুক্ত হয়ে যায়। আমি তখন থেকেই অনুধাবন করেছিলাম-যে মোবাইল অ্যাপ দিয়ে সমাজের নানা সমস্যা ডিজিটাল উপায়ে সমাধান করা যায়। তৈরি করেছিলাম ভ্যাট চেকার অ্যাপ, যা বাংলাদেশ সরকারের প্রায় সাড়ে তিন শত কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এছাড়া সিএনজি ভাড়া জালিয়াতি ঠেকাতে সিএনজি মিটার অ্যাপ, শেয়ার মার্কেটের জন্য ‘ডিএসই অ্যালার্ম’সহ বেশ কয়েকটি সেক্টরে অ্যাপভিত্তিক উদ্যোগ নেই। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়। এরপর আর আমার পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম বঙ্গ একাডেমির শুরুটা কেমন ছিল?
জুবায়ের অ্যাপ একাডেমি নামে আমার একটি ট্রেনিং সেন্টার ছিল। কিন্তু করোনার সময় যখন সব কিছু বন্ধ; তখন চিন্তা করছিলাম কী করা যায়? যেহেতু আমি ছোটবেলা থেকেই একজন ট্রেইনার। আমার তো শেখাতে ভালো লাগে। এজন্য লকডাউনের সময় অনলাইনে ‘বঙ্গ একাডেমি’ নামে ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করি। এ অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এখন ২০ হাজারের বেশি মানুষ যুক্ত হয়েছে। আমার লেকচারগুলো তারা খুব সহজে বুঝতে পারছে। দীর্ঘ ১২ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি লেকচারগুলো তৈরি করেছি। আমি একদম নামে মাত্র কোর্স-ফি রেখেছি, যাতে নিম্ন আয়ের মানুষও এ কোর্সগুলো করে নিজের স্কিল তৈরি করতে পারে। এছাড়া ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করি আমরা। আমার স্বপ্ন বঙ্গ একাডেমি থেকে কোর্স করে মানুষ স্কিল তৈরি করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের যোগ্যতায় কিছু করবে। এ স্বপ্ন নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
আপনার কাজের অনুপ্রেরণা?
আমার অনুপ্রেরণা আমি নিজেই। অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসকে ভালো লাগে, ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকে ভালো লাগে। কিন্তু এমন নয় যে, তাদের আমি অনুসরণ করেছি। আমার কাছে মনে হয়, কাউকে অনুসরণ করে সফল হওয়া যায় না। গতকালের কাজটাকে ছাপিয়ে যেতে পারলাম কি না, আগের প্রজেক্টের থেকে আরেকটু ভালো কিছু করতে পারলাম কি না—এটাই আমার কাছে মুখ্য। বিশেষ করে মানুষের জীবনমানের কোনো পরিবর্তনের জন্য আমি কোনো অবদান রাখলাম কি না—আমি সেটাতেই ফোকাস করি।
বর্তমানে বঙ্গ একাডেমির পাশাপাশি আর কী কী করছেন?
সম্প্রতি বঙ্গ একাডেমির পাশাপাশি আরও দুটো উদ্যোগ রয়েছে। একটি হলো-সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের জন্য ‘মাই কোর্ট’ নামে একটি অ্যাপ। যা এরইমধ্যে আইনজীবীদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে। আরেকটি হলো ‘বঙ্গ স্ক্যানার’। অ্যাপটি বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৯২টি ভাষা বুঝতে পারে এই অ্যাপ।
উদ্যোক্তা জীবনে পরিবার থেকে কেমন সহযোগিতা ছিল?
আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাসা থেকে টাকা নেয়নি কখনো। কিন্তু বাসা থেকে আমাকে যথেষ্ট ছাড় দিয়েছে। কেননা প্রোগ্রামিং বা অ্যাপ ডেভেলপমেন্টে অনেক সময় দিতে হয়েছে; রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছে। আমি যখন অফিস নেই; বেশ কম বয়স তখন। সে সময় তারা বেশ চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু তারা আমাকে বিশ্বাস করেছেন। তারা যে আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন, এটাই আমার জন্য বড় সাপোর্ট।
বঙ্গ একাডেমি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আমি বঙ্গ একাডেমিকে এমনভাবে সাজাতে চাই, যাতে প্রত্যেক ছেলে-মেয়ের কাছে স্কিল ডেভেলপমেন্টের এবং অনলাইন ক্যারিয়ার তৈরি করার জন্য সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্ল্যাটফর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। প্রতিযোগিতার বাজার এখন, বিশ্ব যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে—আমাদেরও তাল মেলাতে হবে। গ্রাজুয়েশন শেষে চাকরির জন্য বসে না থেকে স্কুল-কলেজ থেকেই যে শুরু করা যায়, তা আমি জানাতে চাই। বাংলাদেশের মানুষ যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। বেকার না থেকে, কারও ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে—এ লক্ষ্য নিয়ে বঙ্গ একাডেমি কাজ করবে।
বাংলাদেশি ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলোকে কীভাবে উন্নত করা যায় বলে আপনি মনে করেন?
সবার আগে সার্ভিসের প্রতি খেয়াল রাখা গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো ট্রেইনিং যাতে পর্যাপ্ত হয়, মানুষের উপকার হয়। মানুষ যাতে সার্ভিস নিয়ে দ্বিধায় না থাকে, তা নিশ্চিত করে এগিয়ে যেতে হবে। ই-লার্নিংয়ের জন্য পাইরেসি খুব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আগামীতে বাংলাদেশে ই-লার্নিং খুব বড় ইন্ডাস্ট্রি হতে যাচ্ছে। কিন্তু পাইরেসির জন্য মাথাচাড়া দিয়ে ঠিকমত আগাতে পারছে না। সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি ডিভিশনকে পাইরেসি রোধ করতে এগিয়ে আসতে হবে। সম্ভাবনাময় এ সেক্টরে টিকে থাকতে হলে এর বিকল্প নেই।
সামনে পরিকল্পনা কী?
আমার উদ্যোগ যেন বিশ্বব্যাপী কাজে লাগতে পারে এবং উপকারে আসে—এটাই চাই। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু করার লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই।
Discussion about this post