ড. সাজ্জাদ হোসেন
আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে আমরা দেখতে পাব যে, নগদবিহীন সমাজের অস্তিত্ব সেই সময় থেকেই ছিল, যখন মানব সমাজগুলো ছিল সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে। তখন আমরা একে অপরের পণ্য সরাসরি বিনিময় করতাম অর্থাৎ বিনিময় প্রথার প্রচলন ছিল। সময়ের প্রয়োজনে টাকা বা মুদ্রার প্রচলন হয়। আবার সময়ের প্রয়োজনেই আমরা কাগুজে টাকার পরিবর্তে ডিজিটাল মুদ্রায় লেনদেন করছি। ৮ হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়াতে বিনিময় প্রথার প্রমাণ পাওয়া যায়।
সাড়ে ৩ হাজার বছর আগে থেকে ব্রোঞ্জ, রুপা এবং স্বর্ণের মাধ্যমে পণ্য বিনিময় হতো। মাত্র ১ হাজার বছর আগে চীনের বণিকরা কাগজের মুদ্রা প্রচলন করে। সেখান থেকেই ইউরোপসহ সারা পৃথিবীতে এই কাগুজে টাকার প্রচলন শুরু হয় এবং অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। ১৭ শতকে জনপ্রিয়তা পায় ব্যাংক চেক। কাগুজে টাকা বা স্বর্ণ বহন করা ছাড়াই এই মাধ্যমে লেনদেন করা যেত। বিশেষ করে বণিকদের মাঝে ব্যাংক চেক ব্যবস্থা খুব উপযুক্ত এবং সুবিধাজনক উপায় ছিল। হাতে লেখা লিখিত চেকের প্রাচীনতম নমুনাটি এখনো সংরক্ষিত রয়েছে লন্ডনে অবস্থিত মেসার্স মরিস এবং ক্লেটন ব্যাংকে। এটি ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৬৫৯ তারিখে ইস্যুকৃত এবং ৪০০ মুদ্রার একটি চেক।
এরপর তারবার্তার মাধ্যমে মানি ট্রান্সফার শুরু হয় ১৯ শতকে। ১৮৭২ সালে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন প্রথম ব্যাপকভাবে ওয়্যার ট্রান্সফার পরিষেবা চালু করে। ১৮৭৭ সালের মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ২.৫ মিলিয়ন ডলার ওয়্যার ট্রান্সফার হয়। এরপর আসে এটিএম কার্ডের যুগ। প্রথম এটিএম কার্ড ১৯৬৭ সালে লন্ডনে বার্কলেস দ্বারা প্রচলন হয়েছিল। ৭০-এর দশকে চৌম্বকীয় স্ট্রিপসহ কার্ড আসে। লয়েডস ব্যাংক নিরাপত্তার জন্য একটি পিন ব্যবহার করে তথ্য-এনকোডেড ম্যাগনেটিক স্ট্রিপযুক্ত প্রথম ব্যাংক কার্ড চালু করে। ৮০-এর দশকের মাঝামাঝি ইলেকট্রনিক পয়েন্ট অব সেল (চঙঝ) টার্মিনালগুলোর প্রবর্তন হয়।
যেখানে গ্রাহকরা লেনদেনের জন্য একটি ‘সুইপার’ এর মাধ্যমে তাদের কার্ড সোয়াইপ করতে পারতেন। কাগুজে টাকাই রাজা!Ñ এই উদ্ধৃতিটি এখন হুমকির সম্মুখীন। কারণ, বিশ্ব একটি নগদহীন সমাজে পরিণত হওয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ২০ শতকের শেষের দিকে এবং ২১ শতকের প্রথম দিকে উদ্ভাবনী তথ্য-প্রযুক্তির ঢেউয়ে নগদবিহীন অর্থপ্রদান প্রযুক্তির নানা কার্যকর উপায় বাজারে আসে। লেনদেন হয়ে ওঠে আরও সুবিধাজনক। ডিজিটাল ট্রাঞ্জেকশনের মাধ্যমে দ্রুত এবং কার্যকরী উপায়ে অনলাইন লেনদেন শুরু হয় ঝড়ের গতিতে। পেপাল, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এসব প্রযুক্তি অবলম্বন করে সারাবিশ্বে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
২০১৭ সালে পেপাল ৬ বিলিয়ন লেনদেন অনলাইনে সম্পন্ন করে। ২০০৭ সালে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন এঝগঅ এর সঙ্গে চুক্তি করে মোবাইলের মাধ্যমে লেনদেন প্রক্রিয়া উন্নয়ন করে, যাতে টাকা সরাসরি মোবাইল ডিভাইসে পাঠানো যায়। একই সালে কন্টাক্টলেস কার্ডের প্রচলন শুরু হয়। নগদবিহীন বা কাগুজে টাকাবিহীন ডিজিটাল লেনদেনের এই সংস্কৃতিকে আমরা বলছি ক্যাশলেস সোসাইটি। ক্রেডিট এবং ডেবিট কার্ড, কন্টাক্টলেস কার্ড, ইলেকট্রনিক পেমেন্ট অ্যাপস, কিউ আর কোড, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং বর্তমানে ব্যবহৃত ভার্চুয়াল মুদ্রাগুলো সম্পূর্ণ ক্যাশলেস সোসাইটির পথ প্রশস্ত করেছে। শুধু ইন্টারনেট বা মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় থাকলেই দুনিয়ার যে কোনো প্রান্ত থেকে অর্থ লেনদেন সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশও এই সড়কে যুক্ত হয়েছে কয়েক বছর ধরে।
অনলাইন এবং মোবাইল ব্যাংকিং এখন মানুষের দোরগোড়ায়। বাংলাদেশের অনেক মানুষ এই ইলেকট্রনিক লেনদেনে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। গত পাঁচ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক ডিজিটাল রূপান্তর ঘটেছে। ৪৭ মিলিয়নেরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং ১৬৫ মিলিয়ন মোবাইল গ্রাহকের ফলে বাংলাদেশ দ্রুত ইন্টারনেট এবং ডিজিটালাইজেশনের যুগে চলে যাচ্ছে। ব্যংকসমূহ নিজেদের অ্যাপস ছাড়াও বিকাশ, নগদ এবং রকেটের মতো মোবাইল আর্থিক পরিষেবা চালু করেছে।
প্রাসঙ্গিক অর্থে ডিজিটাল বাংলাদেশ হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপ, যার বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০০৯ সালে। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দেশের সব মানুষের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশ, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ডিজিটাল অর্থনীতি ও ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ে তোলার ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এসব কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নের জন্য আইন, নীতিমালা প্রণয়ন থেকে শুরু করে সামগ্রিক কার্যক্রমের পরামর্শ ও তদারকি করছেন ডিজিটাল বাংলাদেশের আর্কিটেক্ট প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। তার সুযোগ্য নেতৃত্বেই হবে ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ বিনির্মাণ।
দেশের পাঁচ কোটি মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। তারা সম্পূর্ণ নগদ অর্থের (ক্যাশ) ওপর নির্ভরশীল। ক্যাশলেস সোসাইটিতে চলে গেলে দুর্নীতির সুযোগ অনেক কমে যাবে। সম্প্রতি মার্চেন্ট মেশিন প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে নরওয়ে, ফিনল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ড হলো নগদহীন সমাজে পরিণত হওয়ার সবচেয়ে কাছাকাছি তিনটি দেশ। তারপরে হংকং, সুইডেন, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর এবং নেদারল্যান্ডস।
সোর্স : মার্চেন্ট মেশিন ওয়েবসাইট
ক্যাশলেস সোসাইটি বা ডিজিটাল অর্থনীতির প্রধান সুবিধা হচ্ছে- মুদ্রা মুদ্রণ এবং পরিচালনার খরচসহ নানা ঝামেলা দূর করার পাশাপাশি, নগদবিহীন হওয়ায় নির্দিষ্ট ধরনের অপরাধও কমাতে পারে। এছাড়াও ডিজিটাল পেপার ট্রেইলিং থাকাতে মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকি কমে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণের সময় নগদ অর্থ বহন করার ঝুঁকি থাকে না। অন্যদিকে ক্যাশলেস হওয়ার অসুবিধার মধ্যে রয়েছে প্রযুক্তিনির্ভরতা, ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ হওয়ার ঝুঁকি, হ্যাক হওয়ার সম্ভাবনা, প্রযুক্তিগত শিক্ষার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, প্রযুক্তিগত সমস্যা বা হ্যাকিংয়ের শিকার হলে বিকল্প পথে অর্থ সংগ্রহের উৎস নেই- এ রকম আরও কিছু বিষয়। ক্যাশলেস সোসাইটি বিনির্মাণের ক্ষেত্রে সাইবার সিকিউরিটি একটা বড় ইস্যু।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর একটি গবেষণার ফল অনুসারে, সাইবার নিরাপত্তা এখন ব্যাংকিং শিল্পের জন্য একটি প্রধান উদ্বেগের কারণ। দেশের ৫২% ব্যাংক উচ্চ সাইবার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর কারণ হিসেবে রয়েছে- সাইবার নিরাপত্তাকে যথাযথ গুরুত্ব না দেয়া, সাইবার নিরাপত্তার জন্য প্রতিষ্ঠানের বোর্ড পর্যাপ্ত বাজেট ছাড় না দেয়া। সাইবার সিকিউরিটির গুরুত্ব অনুধাবন না করে এটা ধরে নেওয়া হয় যে, সাইবার সিকিউরিটি সহজ এবং সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কর্মীরা অহেতুক অতিরঞ্জিত সমস্যার কথা বলেন।
এসব কারণেই প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইবার হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে। এজন্য আমাদের মতো দেশে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন জনবল বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে সাধারণ ব্যবহারকারীদেরও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করার বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন।
যার বাস্তবায়নের ফলে আমরা দেখেছি মহামারীর মধ্যেও প্রযুক্তির সহায়তায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু থাকায় তা জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখেছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশকে উন্নত, এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং মানুষের জীবনকে সহজ করার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, সেসকল স্বপ্ন তাঁরই দৌহিত্র ডিজিটাল বাংলাদেশের আর্কিটেক্ট প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে ক্যাশলেস সোসাইটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাবে।
লেখক : অধ্যাপক, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি); পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল); প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, আমরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ।
Discussion about this post