আশিক মুস্তাফা
সোমবার বিকেলে শিশু সাহিত্যিক আলী ইমামের মৃত্যুর খবর যখন শুনি তখন গত বছরের ২৯ মে’তে ফিরে যাই। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি। দীর্ঘদিনের পরিচিত ইমাম ভাইকে দেখতে গিয়ে সেদিন হোঁচটই খেয়েছিলাম! করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইমাম ভাই যেন এক ধাক্কায় ৪০ থেকে ৭০-এ নেমে গেলেন। যে আলী ইমামকে মঞ্চে উঠিয়ে দিলে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করত, সেই ইমাম ভাইকে নিথর দেখে বুকের মধ্যে কীসের যেন একটা ঝাপটা অনুভব করি! মুখ দিয়ে কথা সরে না।
ইমাম ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। তিনি ইশারায় জানতে চাইলেন, ভালো আছ? মাথা নেড়ে বলি, আছি। সেদিন আলী ইমাম ও তাঁর ছেলে তানভীর ইমামের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাসার পথ ধরি।
আলী ইমাম অসংখ্য পাঠকের স্বপ্ন রাঙিয়েছেন। এখনও রাঙাচ্ছেন। রাঙাবেন হয়তো আরও অনেক দিন। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত তাঁর গল্পগ্রন্থ- দ্বীপের নাম মধুবুনিয়ার কথা আমরা জানি, যে গ্রন্থ আজও ছোটদের নিয়ে যায় কল্পলোকের অচীন দেশে। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত কিশোর উপন্যাস- অপারেশন কাঁকনপুর, ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত কিশোর রহস্য- তিরিমুখীর চৈতা এবং একই বছর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ- রুপোলী ফিতে অনেক শিশু-কিশোরই পড়েছে। এসব গ্রন্থ বাংলা শিশুসাহিত্যের ক্লাসিক!
শিশুদের সৃজনশীল জগতের দ্বার খুলে দেওয়া আলী ইমাম ১৯৫০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করলেও পরিবারের সঙ্গে থিতু হন ঢাকার ঠাটারীবাজারে। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে পুরান ঢাকার ওয়ারী, টিপু সুলতান রোড, র্যাঙ্কিন স্ট্রিট, নয়াবাজার, নবাবপুর, কাপ্তানবাজার, ফুলবাড়িয়া এলাকায়। লেখালেখি ছাড়াও তিনি অডিও ভিজুয়াল ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে ২০০৬ সালে অবসরে যাওয়ার আগে তিনি ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৭ বছর ইউনিসেফের ‘মা ও শিশু উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম প্রকল্প’ পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তিনি জার্মানির মিউনিখে অনুষ্ঠিত ‘প্রি জুঁনেসি চিলড্রেনস টিভি প্রোডাকশন’ প্রতিযোগিতায় জুরির দায়িত্বও পালন করেন। আলী ইমাম ‘সার্ক অডিও ভিজুয়াল বিনিময় অনুষ্ঠান’-এর প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্বেও ছিলেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সরাসরি প্রচারিত তাঁর উপস্থাপিত অনুষ্ঠান ‘হ্যালো, আপনাকে বলছি’ ছিল তুমুল দর্শকপ্রিয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশনের ওই সময়ের আলোচিত প্রামাণ্য শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’সহ অসংখ্য অনুষ্ঠানের প্রযোজক ছিলেন আলী ইমাম। শিশুসাহিত্যিক হিসেবে জাপান ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে ২০০৪ সালে জাপান ভ্রমণে যান। ২০১৫ সালে জাপান যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম আমিও। জাপান যাওয়ার আগে আলী ইমাম ভাই জাপানবিষয়ক নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। তাঁর দেওয়া জাপানবিষয়ক বেশ কিছু গ্রন্থ এখনও যত্নে রেখেছি আমি।
ছয় শতাধিক বইয়ের লেখক তিনি। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ২০১২ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। শিশুসাহিত্য ছাড়াও তিনি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ফিচার, ভ্রমণকাহিনি ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লিখেছেন।
তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য চর্চার একটি গৌরবময় অধ্যায়ের সমাপ্তি হলেও এটা মনে রাখতে হবে যে, যাঁদের হাত ধরে বাংলা শিশুসাহিত্য শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতির বর্ণিল রূপ ধারণ করেছে, তাঁদেরই একজন আলী ইমাম। অনন্তকাল তিনি শিশুদের মনে স্বপ্ন এঁকে যাবেন- এমনটাই বিশ্বাস!
লেখক- আশিক মুস্তাফা : জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, সমকাল
Discussion about this post