তৌফিক মারুফ
ধানমণ্ডির বাসিন্দা আদিলুর রহমানের হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আগে দুই দিন ধরে ছিল অল্প অল্প জ্বর। আরেকটু দেখার পর পরীক্ষা করানোর চিন্তা করছিলেন। আগে থেকেই কোনো সমস্যা হলে ছুটে যেতেন কাছের ইবনে সিনা হাসপাতালে। কিন্তু গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁর স্বজনদের পক্ষ থেকে ইবনে সিনা হাসপাতালে ফোন করতেই মাসুদ নামে একজন ফোন ধরেন। উপসর্গের কথা শুনেই তিনি বলেন—‘আমাদের এখানে এমন রোগী আনা যাবে না, এমনকি আমাদের কোনো স্টাফের এমন উপসর্গ হলেও সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়।’ এর পরই স্বজনরা তাঁকে নিয়ে হন্যে হয়ে ওঠেন অন্য কোথায় নেওয়া যায় সে জন্য।
পরে একইভাবে শমরিতা হাসপাতালে ফোন দিলে সেখান থেকে কর্তব্যরত কর্মকর্তা ডা. নাজমুল পরিচয় দিয়ে একজন একইভাবে বলেন—‘এখানে এমন উপসর্গধারী রোগী নেওয়া হয় না। অন্য কোথাও নিয়ে যান। আর যদি পরীক্ষা করাতে পারেন তাহলে রেজাল্ট নেগেটিভ এলে এখানে নিয়ে আসতে পারবেন।’
এভাবেই প্রতিদিন কোনো রকম জ্বর সর্দি কাশি গল ব্যথ্যা শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ দেখা দিলেই উত্কণ্ঠার শেষ থাকছে না মানুষের। কী করবেন, কোথায় যাবেন—আগে পরীক্ষা করাবেন, নাকি হাসপাতালে যাবেন, কোন হাসপাতালে যাবেন তা নিয়েই যত উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠায় ভুগতে হচ্ছে। এ অবস্থায় দু-একদিন পরপরই এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে হয়রান হওয়া বা রোগীর মৃত্যু হওয়ার অভিযোগও আসছে। এরই মধ্যে এমন কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ব্যাপক আলোচনায়ও আসে।
সর্বশেষ গত বুধবার রাজধানীর পান্থপথের একটি হাসপাতাল থেকে ডায়ালিসিসের আওতায় থাকা এক কিডনি বিকল রোগীকে বের করে দেওয়া হয়। পরে স্বজনরা ওই রোগীকে নিয়ে আরো তিনটি হাসপাতালে ছোটাছুটি করেন। শেষ পর্যন্ত অন্য একটি হাসপাতালে যেতে না যেতেই তাঁর মৃত্যু হয়।
একই দিন করোনা উপসর্গ নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে শয্যা খালি না থাকায় ফিরে আসেন এক রোগী। তিনি আরো তিনটি হাসপাতাল ঘুরে অন্য আরেকটি হাসপাতালে ঠাঁই পান।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ আছে—এমন রোগীদের জন্য এখন নতুন যন্ত্রণা হচ্ছে কভিড ও নন-কভিড সনদ। কভিড হাসপাতালে গেলে করোনাভাইরাস পরীক্ষার রেজাল্ট পজিটিভ থাকা অপরিহার্য। তা না হলে সুযোগ নেই ওই হাসপাতালে চিকিৎসার। আবার নন-কভিড হাসপাতালেও চায় করোনা পরীক্ষার নেগেটিভ রেজাল্ট। পরীক্ষার নমুনা দেওয়ার পর রেজাল্ট না পাওয়া পর্যন্ত রোগীকে ভর্তি করতে চায় না হাসপাতালগুলো।
বেসরকারি কোনো কোনো হাসপাতাল নিজেদের কর্মীদের করোনা পজিটিভ হলে তাঁদের সেখানে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও অন্য রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ দিচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত করোনাভাইরাস মোকাবেলায় নতুন নির্দেশিকায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে হাসপাতাল ব্যবস্থা নিয়েও নতুনভাবে নির্দেশনা আছে। এ ছাড়া গত ৩০ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সার্কুলারে জানানো হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে আসা কোনো রোগীকে যদি কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত বলে সন্দেহ হয় এবং যদি কোনো কারণে ওই রোগীকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব না হয়, তাহলে ওই রোগীকে ওই হাসপাতালেই অপেক্ষমাণ রেখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ৪টি নম্বরে কল করে ভর্তি ও চিকিৎসাসংক্রান্ত পরামর্শ নিতে বলা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণকক্ষ ওই নম্বর চারটি হচ্ছে ০১৩১৩৭৯১১৩০, ০১৩১৩৭৯১১৩৮, ০১৩১৩৭৯১১৩৯ ও ০১৩১৩৭৯১১৪০। তার পরও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
কুয়েত মৈত্রী বাংলাদেশ হাসপাতালের পরিচালক ডা. সারোয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এখানে উপসর্গ নিয়ে কোনো রোগী এলে যে সবাইকে ফিরিয়ে দিই সেটা ঠিক নয়। কিছু পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।’
মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ম্যানেজমেন্ট ডক্টরস টিমের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ লিটু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এই হাসপাতালটি এখন পুরোপুরি কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল। এখানে নন-কভিড কোনো রোগী রাখার সুযোগ নেই।’
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এখানে কভিড-১৯ উপসর্গ নিয়ে আসা কোনো রোগীকে রাখতে পারি না অন্য রোগী ও চিকিৎসকদের স্বার্থেই। এমন উপসর্গ নিয়ে কেউ এলে তাদের অন্য হাসপাতালে রেফার করে দিই নিয়ম অনুসারেই।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রোগীদের নিয়ে ঠেলাঠেলি আসলেই অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। এখন আর এটা নিয়ে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। যে হাসপাতাল থেকে রোগী ফিরে যাবে সেই হাসপাতালকেই দায় নিতে হবে। সব কিছুর জন্যই মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরকে দায়ী করলে চলবে না। এ ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যদি রোগীদের জন্য আলাদা ট্রায়াল পদ্ধতি অনুসরণ করে তাহলে রোগীদের ফিরিয়ে দিতে হবে না।’
ওই চিকিৎসক নেতা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালের অবস্থা তো আরো খারাপ। এমন অবস্থা আমাদের সবার জন্যই দুঃখজনক। এটা কাটানো উচিত।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপউপাচার্য অধ্যাপক ডা. সারফুদ্দিন আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রোগীদের কাছে এখনো পরিষ্কার নয় যে তারা ঠিক কোথায় যাবে। হাসপাতাল ও পরীক্ষার ব্যবস্থা যদি একই প্রতিষ্ঠানে করা যায় তাহলে হয়তো রোগী ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা কমবে।’ তিনি বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ব্যাপারে মনিটরিং আরো বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন আর কোনো দিকে তাকানো যাবে না রোগীর স্বার্থে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) অধ্যাপক ডা. আমিনুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা কঠোর কোনো পদক্ষেপে যাওয়ার চেয়ে পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য এখন সব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান করতে চাই। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তেরও ব্যাপার আছে।’
তবে নাম প্রাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণ মানুষ হয়তো অনেক কিছুই বুঝতে পারছে না। তাঁরাও সব কিছু বোঝাতে পারছেন না। সরকার চাইলেই সব কিছু করে ফেলতে পারে না। এখানে নানা জটিলতা আছে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের মাধ্যমে। বিশেষ করে চিকিৎসকদের ভেতর থেকে একটি অংশ কোনোভাবেই সরকারকে কঠোর অবস্থানে যেতে দিচ্ছে না। বরং সরকার কোনো কঠোর অবস্থানে গেলেই এক ধরনের অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করে। তখন সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থেকে অস্থিরতা কমাতে ও মানুষের চিকিৎসা যতটুকু পাচ্ছে সেটুকু অন্ততপক্ষে নিশ্চিত করতে শিথিল হতে বাধ্য হয়।
ওই কর্মকর্তারা গত ২৫ মার্চ জারি করা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রোকেয়া খাতুন স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপনের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। যেখানে বলা হয়েছিল, ‘সব পর্যায়ের হাসপাতালসমূহে
সাধারণ রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা, জরুরি চিকিৎসা, নতুন আসা রোগীদের ভর্তি করাসহ সব রোগীদের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোনো হাসপাতাল এ নির্দেশ অমান্য করলে ভুক্তভোগীকে তাত্ক্ষণিক স্থানীয় সেনাবাহিনীর টহলপোস্টে দায়িত্বরত কর্মকর্তা বা নিকটবর্তী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবহিত করার অনুরোধ করা হলো। এ আদেশ অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন বাতিল, লাইসেন্স বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ কিন্তু এরপর চিকিৎসকদের ভেতর থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মুখে পরদিনই ওই প্রজ্ঞাপন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বাতিল করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য হন।
Discussion about this post