বিশেষ প্রতিবেদক
বাংলাদেশের প্রখ্যাত এই শিক্ষাবিদ ও লেখক ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলে থাকাবস্থাতেই সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। তিনি ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯) ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে তার গবেষণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপকও। এছাড়া একাধারে ছিলেন ১৯৫২ সালের ভাষাসংগ্রামী, মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী। ছিলেন দেশের সংবিধানের অনুবাদকও।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলা একাডেমির সভাপতি হিসেবে। ২০১৪ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে সম্মানসূচক ‘পদ্মভূষণ’ গ্রহণ করেন তিনি।
ছোটবেলা থেকেই সাধারণ জীবন যাপনকারী আনিসুজ্জামান মানুষের পাশে দাঁড়াতে কখনো পিছপা হননি। দেশ ও জাতির সংকটে এবং সম্ভাবনায়ও এগিয়ে এসেছেন তিনি। অত্যন্ত পরিশ্রমী আনিসুজ্জামানের লেখনী ও কথাবার্তায় ছিলেন পরিমিত ও আকর্ষণীয়।
১৯৫১ সালে নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিক ও জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ পাস করে বাংলায় ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে স্নাতক সম্মান এবং এমএতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন আনিসুজ্জামান। অনার্সে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার কৃতিত্বস্বরূপ ‘নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক’ বৃত্তি লাভ করেছিলেন।
১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার জন্য যোগদান করেন। তার বিষয় ছিল ‘ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারায ১৭৫৭-১৯১৮’। ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস: ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল’।
১৯৫৮ সালে বাংলা একাডেমি বৃত্তি পেয়েও তা ছেড়ে দিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে অ্যাডহক ভিত্তিতে তিন মাসের জন্য যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। পরে ভারতে গিয়ে প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন।
জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পে অংশ নেন ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। সেখান থেকে অবসর নেন ২০০৩ সালে।
এছাড়া তরুণ বয়সে তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এ ছাড়া শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণ-আদালতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। নিজের সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি বন্ধু ও আড্ডাপ্রিয় মানুষ। যেটুকু কাজ করতে পেরেছি, মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা কম নয়।’
গবেষক ও চিন্তক হিসেবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ষাটের দশকে বাঙালি মুসলমানদের চিন্তাধারার স্বরূপ উন্মোচন করে রচনা করেছেন অসংখ্য গবেষণাগ্রন্থ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়েও তিনি কাজ করেছেন। পেশা শিক্ষকতা হলেও প্রকৃত নেশা লেখালেখি ও সাংগঠনিক কার্যক্রম। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ সাহিত্যের ইতিহাসের ওপর লেখা অসামান্য গ্রন্থ।
দেশে রবীন্দ্র চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনিই। তাঁর প্রবন্ধ-গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে ‘মুসলিম বাংলার সমসাময়িকপত্র’ (১৯৬৯), ‘মুনীর চৌধুরী’ (১৯৭৫), ‘স্বরূপের সন্ধানে’ (১৯৭৬), ‘আঠারো শতকের বাংলা চিঠি’ (১৯৮৩), ‘মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’ (১৯৮৩), ‘পুরোনো বাংলা গদ্য’ (১৯৮৪), ‘মোতাহার হোসেন চৌধুরী’ (১৯৮৮), ‘আমার একাত্তর’ (১৯৯৭), ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর’ (১৯৯৮), ‘আমার চোখে’ (১৯৯৯), ‘বাঙালি নারী: সাহিত্যে ও সমাজে’ (২০০০), ‘পূর্বগামী’ (২০০১), ‘কাল নিরবধি’ (২০০৩) উল্লেখযোগ্য।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় তার রয়েছে আকরগ্রন্থ ‘আইন-শব্দকোষ’। তার এসব কাজ জাতিকে, ভাষাকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে। সেজন্য দেশ-বিদেশে পেয়েছেন পুরস্কার ও সম্মাননা।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৬); স্ট্যানলি ম্যারন রচনা পুরস্কার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৮); দাউদ পুরস্কার (১৯৬৫); বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০); অলক্ত পুরস্কার (১৯৮৩); একুশে পদক (১৯৮৫); আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬); লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৬); বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার (১৯৯০); দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক (১৯৯৩) ও অশোককুমার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪)। এছাড়া রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডি.লিট (২০০৫)।সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তাকে বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে।
Discussion about this post