মুস্তাফিজ শফি
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রয়াণের হৃদয়বিদারক খবর শুনে তাৎক্ষণিকভাবে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম- ‘ভীষণ কষ্ট লাগছে। মাথার ওপর থেকে ছায়া সরে গেল।’ তাৎক্ষণিকভাবে লেখা হলেও সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এ আমার ও সমকালের জন্য চিরন্তন আক্ষেপ। মেনে নেওয়া রূঢ় বাস্তবতায় হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা কষ্টের কথা। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা চিরতরে চলে গেলে সংবাদমাধ্যমে আমরা অনেক সময় খানিকটা প্রচল ধারায় অভিভাবক হারানোর কথা বলি বা লিখি। কিন্তু আনিসুজ্জামান- দশকের পর দশক জুড়ে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের অভিভাবক ছিলেন। শনিবার সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা যে ‘একজন অভিভাবকের বিদায়’ উৎকীর্ণ করেছি, তা নিছক আলংকারিক নয়। তিনি প্রকৃতপক্ষেই সমকাল পরিবারের অভিভাবক ছিলেন। আমার ওই সংক্ষিপ্ত ‘ওয়ান লাইনার’ স্ট্যাটাসে জুড়ে দিয়েছিলাম স্যারের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে তোলা কয়েকটি আলোকচিত্র। আগে ততটা খেয়াল করিনি, কিন্তু এখন দেখে মনে হয়- তার সান্নিধ্যের প্রশান্তি আলোকচিত্রেও ফুটে ওঠে। বয়সী বটের গাঢ় ছায়া যেমন।
দেশের অনেক মনীষী প্রসঙ্গেই আমরা বলে থাকি- সমকালের সঙ্গে তার সম্পর্ক সূচনালগ্ন থেকে। কিন্তু অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সঙ্গে সমকালের সম্পর্ক তার চেয়েও পুরোনো ও পরিণত। সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, আমাদের প্রিয় সারওয়ার ভাই ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সরাসরি ছাত্র। ষাট দশকের গোড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আমাদের এই দুই অভিভাবকের মধ্যে সম্পর্কের যে ভিত গড়ে দিয়েছিল, তা আমৃত্যু অটুট ছিল। শিক্ষক ক্রমেই শ্রেণিকক্ষের বাইরে জাতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন; ছাত্র পরিবর্তিত হয়েছেন রাশভারী সম্পাদকে; কিন্তু দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের সারল্য ছিল কলা ভবনের দিনগুলোর মতোই। প্রিয় ছাত্রের অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সমকালের বানানরীতি নির্ধারণের দায়িত্ব নেন। পরবর্তী বছরগুলোতে- সে সমকাল-ব্র্যাক ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার হোক, বা হোক ঈদসংখ্যার লেখক সম্মিলনী, কিংবা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান- তিনি ছিলেন সমকালের সব আয়োজনের উজ্জ্বলতম মুখ। ছাত্রের পঁচাত্তরতম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে জাতীয় কমিটির সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন সানন্দে। সারওয়ার ভাইয়ের প্রয়াণের পরও নাগরিক শোকসভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। এখন যখন তিনি নিজেই প্রয়াত, আমরা স্বজন বিচ্ছেদে আনত, মুহ্যমান।
সারওয়ার ভাইয়ের প্রয়াণের পর সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে যাদের আমি ভরসা বলে মেনেছি, আনিসুজ্জামান ছিলেন তার প্রথম সারিতে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমকাল যখনই তাকে চেয়েছি, আন্তরিকতার সঙ্গে সাড়া দিয়েছেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন সমকালের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেরণাদাতা। সমকাল পরিবারের সঙ্গে তার গড়ে উঠেছিল স্নিগ্ধ ও নিবিড় এক পারিবারিক সম্পর্ক। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা আমরা সহজে পূরণ করতে পারব বলে মনে হয় না।
শুধু সমকালের নয়, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মধ্যমণি। তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন বটে; মেধা, প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্বে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবার শিক্ষক। বাংলা বিভাগে যারা তার সরাসরি ছাত্র-ছাত্রী ছিলেন, তাদের ওপর তার প্রভাব কতটা ব্যাপক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখলে তা বোঝা যায়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধাবোধের যে বহিঃপ্রকাশ, শিক্ষকের মর্যাদার প্রশ্নে সেগুলো দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত আমি তার সরাসরি ছাত্র নই; কিন্তু তিনি নিঃসন্দেহে আমারও শিক্ষক। তিনি আমাকে তার আর দশজন ছাত্রের মতোই স্নেহ করেছেন, ভালোবেসেছেন।
আনিসুজ্জামানের কাছে আমরা প্রতিনিয়ত শিখেছি- যেমন গদ্যে, তেমন গবেষণায়। গদ্য ও গবেষণার মধ্যে বিরোধ চিরন্তন। যারা সুখপাঠ্য ভাষা নিয়ে বেশি মনোযোগী, গবেষণায় মনোনিবেশের সময় তারা কম পান। উল্টোটাও দেখা যায়, গবেষণায় ভালো কিন্তু গদ্যে খটোমটো। আনিসুজ্জামানের মধ্যে আমরা এই দুই চরিত্রের বিরল মিশ্রণ দেখতে পাই। তার গবেষণার জগৎ একই সঙ্গে সুখপাঠ্য গদ্যময়। লেখক হিসেবে আমি বুঝি গদ্যের মাধুর্য কতটা গভীর হতে পারে। তার ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ (১৯৬৪) কিংবা ‘আঠারো শতকের বাংলা চিঠি’ (১৯৮৩) পড়লে গবেষক হিসেবে তার অভিনিবেশ এবং গদ্যকার হিসেবে তার মুনশিয়ানা স্পষ্ট হয়। আমার প্রিয় গ্রন্থ তার আত্মকথন ‘কাল নিরবধি’ যেন আবহমান বাংলার কথা বলে এবং ‘বিপুলা পৃথিবী’ যেন সত্যিই আমাদের সামনে খুলে দেয় এক অজানা জগৎ। নৈর্ব্যক্তিক ও তথ্যনিষ্ঠভাবে এদেশের গত ষাট বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতির গতিধারা সুতীক্ষষ্ট দক্ষতায় তিনি মহাকালের পাত্রে লিখে রেখেছেন, আমরা তার অমিয় সুধায় স্নাত ও সমৃদ্ধ।
সমসাময়িক অনেক বুদ্ধিজীবীর জন্য আনিসুজ্জামান কেবল এ কারণেই ঈর্ষণীয় হতে পারেন যে, বিংশ শতাব্দীতে বাঙালি জাতির যেসব বড় অর্জন, তার সবগুলোর সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। আমরা দেখি, ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম পুস্তিকা ‘ভাষা আন্দোলন : কী ও কেন’ (১৯৫২) তার লেখা। কলেবর যেমনই হোক, লেখকের বয়স যত কমই হোক; একটি জাতির গৌরবের ইতিহাসের প্রথম পুস্তিকা রচনা অসামান্য কৃতিত্ব। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, প্রবাসী সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন, ভারতে আশ্রয় নেওয়া শিক্ষকদের সংগঠিত করেছেন। শুধু তাই নয়, স্বাধীন রাষ্ট্রের পবিত্র সংবিধানের বাংলা ভাষ্যও তৈরি করেছেন। ভাষা, স্বাধীনতা, রাষ্ট্র- বাঙালি জাতির তিন মহান অর্জনের সঙ্গেই এমন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার গৌরব আর খুব কম বুদ্ধিজীবীর রয়েছে বলে আমরা জানি। আমরা দেখি, কাল নিরবধির ‘পূর্বাভাস’ হিসেবে তিনি নিজেই বলছেন- ‘পাঠকের কাছে যদি আমার স্মৃতিকথার কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকে, তা এই জন্য যে, আমি প্রচুর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী এবং বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির সাহচর্যধন্য।’
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের যে দিকটি অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র, তা হচ্ছে তার রাজনৈতিক চেতনা। মুক্তবুদ্ধি, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে তিনি যেভাবে আজীবন আপসহীন ভূমিকা রেখে গেলেন, তার তুলনা নেই। নিন্দার কাঁটা পায়ে ফোটার ভয়ে অনেকে ধর্মীয় স্বাধীনতা এমনকি ধর্মহীনতার স্বাধীনতা নিয়ে জনপরিসরে কথা বলতে চাইতেন না। আনিসুজ্জামান সেক্ষেত্রেও রেখে গেছেন দৃঢ় ভূমিকা। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে তিনি সবসময়ই সোচ্চার ছিলেন। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের জন্য শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালতের তিনি ছিলেন অন্যতম স্তম্ভ। বৈরী রাজনৈতিক বাস্তবতার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে তিনিই অভিযোগনামা রচনা করেন।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী যখন নীরবতা পালন করেছেন, তখন সোচ্চার ছিলেন আনিসুজ্জামান। রক্তচক্ষু কিংবা ভালোবাসার কোমল দৃষ্টি- কোনো কিছুই তাকে সত্যকথন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে তিনি সারাজীবন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত আদর্শের কথাই বলে গেছেন। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক- শ্রেণি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে যে কেউ তার সঙ্গে মতবিনিময়ের অবকাশ পেয়েছে। ভিন্নমতের প্রতি তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল, আমরা দেখেছি- বিপরীত মেরুর দুই গুরুত্বপূর্ণ কবি- শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ- দু’জনের প্রয়াণের পর যে জাতীয় স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়, তার দুটিরই সভাপতি আনিসুজ্জামান। ভিন্নমতকে এমন ধৈর্য ও যুক্তির সঙ্গে মোকাবিলার উদাহরণ আমাদের সমাজে কম; অপরের মত- তা তার বিপরীত হলেও তিনি স্থির চিত্তে তা শুনে নিজের অসাম্প্রদায়িক-উদার রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় অটল থাকতে পারতেন। এমন একজন ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’ আমাদের সমাজে উদাহরণসম। আনিসুজ্জমানের রাজনৈতিক চেতনা ও মানবিক বোধ বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক মেরুদণ্ড তৈরির অন্যতম উপাদান হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন জাতির জন্য বটবৃক্ষের মতো। আমাদের ভাষা, রাষ্ট্র, রাজনীতি, সংগ্রাম, অধিকারের প্রশ্নে সবাই তার ছায়া পেয়েছে। এসব প্রশ্নে তিনি কাউকে নিরাশ করেননি। ঠিক যেমন বটবৃক্ষের গাঢ় ছায়া প্রখর রৌদ্রে সবাইকে আশ্রয় দেয়। কেবল বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গ- এবং তা পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে যেখানেই বাঙালি আছেন, তার সেই ছায়া বিস্তৃত ছিল। আনিসুজ্জামান পশ্চিমবঙ্গে জন্মেছেন, পূর্ববঙ্গে বেড়ে উঠেছেন। আর নিজের সৌরভ ছড়িয়েছেন এপার-ওপার দুই বাংলা মিলে। এক সার্থক জীবনযাপন করে তিনি দেখিয়েছেন, আদর্শ বাঙালি চরিত্র কেমন হতে পারে।
আমরা বিশ্বাস করি না, শারীরিক প্রস্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির জীবনে আনিসুজ্জামান পর্বের সমাপ্তি হয়েছে। বরং এর মধ্য দিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম এক নতুন অধ্যায়ে। আমরা যারা ব্যক্তি আনিসুজ্জামানকে ভালোবাসি, তার আদর্শের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করি; মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধি, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবাধিকারের পতাকা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এখন তাদের। এক্ষেত্রে আনিসুজ্জামানের জীবন ও কর্ম, প্রজ্ঞা ও দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের অনিঃশেষ পাথেয়। আমরা যদি রোদে পুড়ে যাই, যদি তাপে দগ্ধ হই, বটবৃক্ষ আনিসুজ্জামানের গাঢ় ও বিস্তৃত ছায়া আমাদের সুশীতল ছায়া দিয়ে যাবে।
আনিসুজ্জামান চলে গেলেও রেখে গেছেন সমৃদ্ধ এক বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকার। আমরা সেই উত্তরাধিকারের অনিবার্য অংশ। আমাদের কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা এই প্রাজ্ঞ-অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের জন্য।
Discussion about this post