রেজাউল করিম রাজা
দেশ থেকে ‘লকডাউন পরিস্থিতি’ তুলে দিলে ত্রিমুখী বিপদের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সময় অফিস-আদালত, গণপরিবহনসহ সব কিছু খুলে দিলে ঝুঁকির মাত্রা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি এ আশঙ্কার কথা বলেন।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, লকডাউন বা সব কিছু বন্ধ করে দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের চলাচলকে থামিয়ে দিয়ে তাদের ঘরে রাখা, একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের শারীরিক দূরত্ব তৈরি করা। এই দুটো কাজের মাধ্যমে চেইন অব ইনফেকশান (সংক্রমণের ধারা) ভেঙে ফেলা যায়। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হচ্ছে- যতদিন পর্যন্ত ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াতে থাকবে ততদিন এটা করতে হবে। সংক্রমণ চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। তখন লকডাউন, বিচ্ছিন্নতা, অবরোধ বা সাধারণ ছুটি যাই হোক না কেন, সংক্রমণ কমার হারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ধাপে ধাপে শিথিল করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে, সরকার যখন ‘লকডাউন পরিস্থিতি’ আরোপ করে, তখন ‘লকডাউন’ শব্দটি ব্যবহার করেনি। এ বিষয়ে তাদের কোনো ব্যাখ্যা হয়তো আছে, যা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলো। মানুষ প্রথম দিকে এটাকে লকডাউন হিসেবে গ্রহণ করলেও পরবর্তী সময়ে এটাকে সাধারণ ছুটি হিসেবেই গ্রহণ করেছে। ফলে জনসমাগম কিছুটা কমলেও পুরোপুরি কমলো না। আমরা পোশাক শ্রমিকদের আসা-যাওয়া দেখলাম, অনেক লোকের সমাগমে জানাজা, ঈদে বিভিন্ন স্থানে আসা-যাওয়া দেখলাম। ফলে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকলো। আমরা আশঙ্কা করেছিলাম এই ভাইরাসের সংক্রমণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে আরও দুই থেকে চার সপ্তাহ লাগতে পারে। সংক্রমণের গতি যখন উর্ধমুখী ঠিক সেই সময়ে সব কিছু খুলে দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত করোনা ভাইরাসকে একটি তাণ্ডব চালানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া।
সবকিছু খুলে দিলে কতটা ঝুঁকি তৈরি হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলে, সবকিছু খুলে দিলে বিপদ হবে ত্রিমুখী। প্রচুর মানুষ অসুস্থ হবে, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে এবং একই সঙ্গে মৃত্যু ঘটবে। এই অসুস্থতার কারণে মানুষের মধ্যে ভালো থাকার যে অনুভূতি সেটা নষ্ট হয়ে যাবে। এসব মানুষের চিকিৎসার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আমাদের জাতীয় অর্থনীতির ওপরেও চাপ ফেলবে। এছাড়া অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে না হয় বাড়িতে বন্দী থাকবে। ফলে যে উদ্দেশ্যে অর্থনীতির চাকা সচল করার জন্য লকডাউন তুলে নেওয়া হচ্ছে, তার বিপরীত ফল হবে। লকডাউন পরিস্থিতি আরও অন্তত দুই সপ্তাহ বাড়িয়ে দিলে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হতো, এখন তার চেয়ে দ্বিগুণ বা চারগুণ ক্ষতি জাতীয় অর্থনীতি এবং দেশের মানুষকে মোকাবিলা করতে হতে পারে। এমন অসময়ে বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ার এটাই হচ্ছে করুণ পরিণতি।
করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে এমনিতেই আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে। তিনশো নিরানব্বইটা ভেন্টিলেটর মেশিন বা আইসিইউ রয়েছে, এই শক্তি দিয়ে আমরা যখন সংক্রমণ বেড়ে যাওয়াটা এলাউ করছি, তখন তার অর্থ দাঁড়ায়, আমি কিছু মানুষের মৃত্যুকে এলাউ করছি। এটা এক ধরনের অবহেলাজনিত হত্যা। লকডাউন তুলে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে দেশের কিছু মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা কাজ করছে।
উল্লেখ্য, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের গতি যখন উর্ধ্বমুখী তখন লকডাউন পরিস্থিতি শিথিল করে অফিস আদালত, সীমিত আকারে গণপরিবহন ও মার্কেট-দোকানপাট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত ২৫২৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। আর মারা গেছেন ২৩ জন, যা উর্ধ্বমুখী প্রবণতারই অংশ।
এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা জুন মাসে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
Discussion about this post