সাব্বির নেওয়াজ
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষা খাতও বড় ধরনের ধাক্কার মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদরা। তাদের মতে, শিক্ষা খাতের সবচেয়ে বড় ধাক্কা পড়বে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। অন্তত ৮০ থেকে ৮৫ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে যাবে এই দুটি স্তর থেকে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে লিঙ্গসমতা অর্জনকারী বাংলাদেশ সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়বে মেয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে। দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ায় বিপুলসংখ্যক পরিবার তাদের কন্যাশিশুকে বিয়ে দিয়ে দেবে। বাল্যবিয়ের সংখ্যা বাড়বে দেশে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা `পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার` (পিপিআরসি) ও `ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট`-এর (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণায় সম্প্রতি এ তথ্য উঠে এসেছে- করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির প্রভাবে শহরের নিম্নআয়ের মানুষের আয় কমেছে ৮২ শতাংশ। আর গ্রামাঞ্চলের ন্নি আয়ের মানুষের আয় ৭৯ শতাংশ কমেছে। অনেক ক্ষেত্রে কোনো রকমে তিন বেলা খেতে পারলেও পুষ্টিমান রক্ষা করতে পারছে না তারা। এসব পরিবারের কন্যাশিশুর লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন শিক্ষাবিদরা। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীর মতে, করোনার এই সংকটের সময়ে চর কিংবা হাওর অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়বে বেশি হারে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের অভিভাবকদের মধ্যে একদিকে যেমন সচেতনতার অভাব রয়েছে, অন্যদিকে তাদের আর্থিক সঙ্গতিও নেই। এই দুর্যোগে তারা সন্তানদের কাজে লাগিয়ে সংসারের জন্য বাড়তি আয়ের চেষ্টা করবেন।
তিনি বলেন, করোনার সংকটে বাল্যবিয়ে ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে- দারিদ্র্য কাটাতে অনেক অভিভাবকই মেয়েদের অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে পরিবারের সদস্যসংখ্যা কমানোর চেষ্টা করেন। এভাবেই সমাজে বাল্যবিয়ের হার বৃদ্ধি পায়। আর ছেলেদের স্কুল-কলেজের পাঠ শেষ না হতেই সংসারের দায়িত্ব দিয়ে দেন। অথবা বাবার সঙ্গে কাজে যোগ দিতে ছেলেদের বাধ্য করেন।
সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যে দেখা যায়, গত এক দশকে দেশে বাল্যবিয়ের হার অনেক কমে এসেছে। অভিভাবকদের সচেতনতা আর আর্থিক সঙ্গতি বৃদ্ধির কারণেই এ ক্ষেত্রে সফলতা এসেছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু করোনা মহামারি প্রায় সব শ্রেণিপেশার মানুষেরই আয় কমিয়ে দিয়েছে। শহর কিংবা গ্রামের শ্রমজীবী মানুষের রোজগার নেই বললেই চলে। অনেক সচ্ছল পরিবারেও এখন অনটন চলছে। এ অবস্থায় আগের সফলতায় ছেদ পড়তে পারে।
শিক্ষাবিদরা বলেন, দেশের ২০ শতাংশ মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। করোনার কারণে আরও ২০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক মাল্টিপল ক্লাস্টার সার্ভে অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে হার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় কম। জরিপে বলা হয়, ২০০৬ সালে দেশে বাল্যবিয়ের সংখ্যা ছিল ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৪ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ। বিআইডিএসের ২০১৭ সালের জরিপে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে বাল্যবিয়ের সংখ্যা ৪৭ শতাংশ (১৮ এর নিচে); অন্যদিকে ১৫ বছরের নিচে বিয়ের সংখ্যা ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী রওশন আক্তার জানান, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১৫ বছরের নিচে বিয়ে সম্পূর্ণ বন্ধ করা হবে। এরই মধ্যে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ সংশোধন করা হয়েছে। এই আইনে সাজা ও জরিমানা বাড়ানো হয়েছে। অভিভাবক, কাজি এমনকি যারা বাল্যবিয়েতে সহযোগিতা করবে, তাদেরও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, করোনার হোক, আর যে কারণেই হোক- প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া আছে বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে যেন কোনো ছাড় দেওয়া না হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাল্যবিয়ে রোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন ১০৯ চালু করা হয়েছে। এই সংখ্যাটি আবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের সব বইয়ের পেছনে প্রিন্ট করে দেওয়া হয়েছে, যাতে যেখানে বাল্যবিয়ে অথবা নারী নির্যাতন হবে তার তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্নিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, অভাবের তাড়নায় কন্যাশিশুদের যেন অভিভাবকরা বিয়ে দিয়ে না দেন, সেজন্য নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর একটি তালিকা করে বিশেষ ভাতা চালু করা দরকার।
প্রাথমিক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ বলেন, আর্থিক অনটনে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা গ্রহণে যাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয় সে জন্য বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। করোনার এই সংকটের সময়ে উপবৃত্তির টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। উপবৃত্তির প্রকল্পের মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে। ঈদের আগে মোবাইল ফোনে বকেয়া টাকাও দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে নতুন করে অতি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের তালিকা করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও টাকার পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। চেষ্টা করা হচ্ছে কোনোভাবেই যাতে একজন শিক্ষার্থীও ঝরে না পড়ে।
Discussion about this post