পার্থ শঙ্কর সাহা
করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের ঘোষণা করা সাধারণ ছুটির মধ্যে ঢাকার আশপাশের পাঁচটি নদ-নদীর পানির মানের উন্নতি হয়েছে। বিভিন্ন নিরিখে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর পানির মান দ্বিগুণেরও বেশি উন্নত হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণে এ চিত্র উঠে এসেছে।
পানিবিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর দূষণের মূল দুই উৎসের অন্যমত শিল্প বর্জ্য। করোনার সাধারণ ছুটির সময় কলকারখানা বন্ধ ছিল। তাই স্বভাবতই পানির মান বাড়বে, এটা প্রত্যাশিত। তবে দূষণের আরেক উৎস ওয়াসার পয়োবর্জ্য বন্ধ হয়নি। এটি বন্ধ হলে পানির মান আরও ভালো হতো।’
নদীদূষণ পরিমাপে অন্যতম এক মাপকাঠি হলো পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) মান নিরূপণ। প্রতি লিটার পানিতে ন্যূনতম ৫ মিলিগ্রাম ডিও থাকলে ওই পানি মানসম্পন্ন বলে বিবেচনা করা হয়। পানির মান বিবেচনার ক্ষেত্রে বিওডি (জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অক্সিজেনের চাহিদা) এবং সিওডি (অজৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অক্সিজেনের চাহিদা) আরও দুই মানদণ্ড। এ দুটোর পরিমাণ বেড়ে গেলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। এ দুইয়ের পরিমাণ কমে যাওয়ার অর্থ হলো দূষণের মাত্রা কমে যাওয়া। এর মানে হলো, দ্রবীভূত অক্সিজেন বেড়ে যাওয়া।
পরিবেশ অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর নানা পয়েন্ট থেকে নিয়মিত পানির মান পরীক্ষা করে। নদীগুলোর দূষণ সাধারণত শুরু হয় নভেম্বর মাস থেকে। দিন দিন তা বাড়তে থাকে। এপ্রিল মাসে দূষণ চরম অবস্থায় পৌঁছায়। এপ্রিল মাসকেই দূষণের সবচেয়ে বড় সময় বলে মনে করে অধিদপ্তর। সরকারি এ দপ্তরের গত তিন বছরের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেছে, পাঁচ নদীর পানির মান চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বেশ বেড়েছে।
ঢাকার একেবারে গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদী বুড়িগঙ্গা। গত বছরে (২০১৯) বুড়িগঙ্গার মিরপুর ব্রিজের কাছের পানিতে ডিওর পরিমাণ ছিল শূন্য শতাংশ। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক শূন্য ২ মিলিগ্রাম। গত বছরের এপ্রিলে বিওডি ছিল ২০ মিলিগ্রাম। এ বছরও এর মানের কোনো হেরফের হয়নি। তবে গত বছর এপ্রিলে এখানকার পানিতে সিওডি ছিল ৯২ মিলিগ্রাম, যা এবার ৭৬ মিলিগ্রাম।
গাবতলী ব্রিজের কাছে তুরাগ নদে গত বছরের এপ্রিল মাসে ডিও ছিল শূন্য দশমিক ১২ মিলিগ্রাম। এ বছর এর ডিওর পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। আশুলিয়ায় তুরাগের ডিও গেল বছর ছিল শূন্য মিলিগ্রাম। এবার তা বেড়ে হয়েছে ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
শিল্প বর্জ্যের দূষণে বিপর্যস্ত শীতলক্ষ্যা। নদীর দুপাশ দিয়ে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার অনেকগুলোরই বর্জ্য শোধনাগার নেই। সেই দূষণের নদীতেও এবার এসেছে প্রাণ। এ নদীর ডেমরা ঘাট ও এসিআই এলাকায় গত বছর ডিও ছিল যথাক্রমে ১ ও ১ দশমিক ২ মিলিগ্রাম। এবার তা হয়েছে ১ দশমিক ৩১ এবং ১ দশমিক ২৪ মিলিগ্রাম।
বালু নদের দূষণচিত্রেও আশাব্যঞ্জক ফল। এ নদীর হোসেন ডায়িং এলাকার পয়েন্টে গত বছর পানিতে ডিওর পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ১ মিলিগ্রাম। এবার তা হয়েছে শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ। নদের বালু ব্রিজ পয়েন্টে গত বছরের এপ্রিলে পানিতে ডিওর পরিমাণ ছিল শূন্য, এবার হয়েছে ১ দশমিক ২২ মিলিগ্রাম।
পাঁচ নদ-নদীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মান বেড়েছে ধলেশ্বরী নদীর পানির। এ নদীতে এ বছর এপ্রিলে ডিওর পরিমাণ ন্যূনতম নির্ধারিত মাত্রা অর্থাৎ ৫ মিলিগ্রাম ছাড়িয়ে হয়েছে ৭ দশমিক ১। গত বছর এ মাসেই এর মান ছিল ২ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম।
ধলেশ্বরীর এ পয়েন্টে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসের পানির মানও পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, ওই মাসে এ পয়েন্টে পানির ডিও ছিল ১ দশমিক ৩৫ মিলিগ্রাম।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘লকডাউনের সময় আমরা কিছু নমুনা নিয়েছি। প্রতিটি নিরিখেই ঢাকার আশপাশের নদ-নদীগুলোর পানির মানের উন্নতি লক্ষ করেছি। মানুষের নানাবিধ কাজ কমে যাওয়ার ফলেই এই উন্নয়ন।’
রফিক আহম্মদের মতে, ঢাকার নদ-নদীগুলোর দূষণের প্রধান দুই উৎস শিল্প বর্জ্য এবং ওয়াসার পয়োবর্জ্য। এর পাশাপাশি আছে নৌযানের জ্বালানির বর্জ্য।
প্রথম আলো ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকার কাছের শ্যামপুর-কদমতলী শিল্প এলাকার শিল্পদূষণ নিয়ে একটি গবেষণা করে। ওই শিল্প এলাকার নামা শ্যামপুর বস্তি, শ্যামপুর লঞ্চঘাট এলাকা এবং এ ঘাটের কাছে বুড়িগঙ্গা থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়। তিন জায়গার তিন বোতল পানি ওই দিনই দেওয়া হয় বুয়েটের ব্যুরো অব রিসার্চ ট্রেনিং অ্যান্ড কনসালটেশনে (বিআরটিএ)।
পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ অনুযায়ী, শিল্প বর্জ্য বহন করা পানিতে বিওডির সহনীয় মাত্রা প্রতি লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম এবং সিওডির ২০০ মিলিগ্রাম। শ্যামপুরে নামা বস্তিতে বিওডির পরিমাণ ১২০ মিলিগ্রাম আর সিওডি ৩৫৮ মিলিগ্রাম। লঞ্চঘাটে যেখানে এই শিল্পের বর্জ্য গিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ছে, সেখানে বিওডি ৩০৪ মিলিগ্রাম এবং সিওডি ৫৪৯ মিলিগ্রাম। শিল্প বর্জ্যে হাইড্রোজেন সালফাইডের সহনীয় মাত্রা এক মিলিগ্রাম। কিন্তু নামা শ্যামপুরের পানিতে এর পরিমাণ ১২৫ মিলিগ্রাম আর লঞ্চঘাটে ৯০ মিলিগ্রাম।
লকডাউনের ফলে এই শিল্প বর্জ্যের দূষণ থেকে রেহাই পেলেও ওয়াসার পয়োবর্জ্য এখনো একটি বড় দূষণকারী হিসেবে রয়ে গেছে বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সোবহান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন রাজধানীতে ১৫ লাখ ঘনমিটার পয়োবর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে ১৪ লাখ ঘনমিটারই অপরিশোধিত অবস্থায় ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলোতে গিয়ে মেশে। এর থেকে নিষ্কৃতি না পেলে নদীগুলোর রক্ষা নেই।
ঢাকার নদীর প্রকৃত দূষণকারী কে এবং কারা কতটুকু করছে, এ নিয়ে মতভেদ যে আছে তা স্বীকার করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। তিনি বলেন, ‘ওয়াসাকে ধরলে তারা শিল্পমালিকদের দোষ দেয় আবার শিল্পমালিকদের বললে তাঁরা ওয়াসাকে দোষ দেন। দুপক্ষকে একসঙ্গে বসালে তারা বলে, আরও ভিন্ন উৎসও তো আছে।’
উৎস নিয়ে মতভেদ থাকুক। কিন্তু দূষণ যে চূড়ান্ত মাত্রায়, তা নিশ্চিত। আর তা হচ্ছে মানুষের অন্যায্য ক্রিয়াকর্ম, এমন মন্তব্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের। এই পরিবেশবিদের কথা হলো, ‘অনেক ক্ষতির মধ্যে করোনা আমাদের একটি শিক্ষা দিল যে, আমাদের আচরণের জন্যই এই দূষণ। এখন এই আচরণ পাল্টাতে হবে। এবার প্রকৃতির ওপর মানুষের অন্যায্য আচরণ একটু কমেছে বলে পানির হাল ফিরেছে।’
করোনার এই মহামারির মধ্যেই আগামীকাল ৫ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবার জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউনেপ) এই দিবসে থিম নির্ধারণ করেছে ‘টাইম ফর নেচার’ বা সময়টা প্রকৃতির। প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার কথা আছে এবারের আহ্বানে। পরিবেশকর্মীরা এখন বলছেন, দূষণ কমে নদীগুলোর এই যে হাল ফিরল, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনের পরিকল্পনা নিতে হবে। আর এ জন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘নদীগুলোর পানির মান বৃদ্ধি একটি ভালো খবর। একে আমরা ধরে রাখতে চাই। এ জন্য অবশ্য মানুষকে সচেতন হতে হবে। তবে আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে। সুত্র -প্রথম আলো
Discussion about this post