আর কিছুদিন পরেই আমাদের চোখের সামনের পৃথিবীতে করোনাভাইরাস আক্রমণের বছরপূর্তি হবে, এইতো আর মাস চার/পাঁচ মাত্র। এরই মধ্যে সাড়ে তিন লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, আক্রান্ত হয়েছে ৬৪ লাখ মানুষ, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৮ লাখ মানুষ- তার মানে এখনও হাসপাতালে কিংবা আক্রান্ত হয়ে করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ। বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ৭২০, এবং এই সংখ্যা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে, মৃত বা আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক কেবল বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই। মাত্র ছয় মাসের একটু বেশি বয়সী একটি ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারি পৃথিবীকে যে ভয়ংকর বিপদে ফেলে দিয়েছে তাতে যতদিন পর্যন্ত না এর প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কার হয় ততদিন পৃথিবীকে এই বিপদ মাথায় নিয়েই কাটাতে হবে। যদিও পৃথিবীর তো এরকম মহামারির সঙ্গে বসবাসের অভিজ্ঞতা রয়েছে, বিশেষ করে বর্ণবাদের মতো ভয়ংকর রোগতো মহামারিই, হলিউডের অভিনেতা জর্জ ক্লুনি যথার্থই বলেছেন, করোনা নয় বরং বর্ণবাদই আমেরিকার (পড়ুন গোটা পৃথিবীর) জন্য সবচেয়ে বড় মহামারি। মজার বিষয় হলো, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারির বয়স ছ’মাসের একটু বেশি হলেও বর্ণবাদ নামক মহামারির বয়স শত শত বছর। সমাজবিজ্ঞানীরা এ প্রশ্ন আজকাল তুলছেন যে, মানুষের জিনের ভেতরই বর্ণবাদ নামক রোগের জীবাণু লুকিয়ে থাকে কিনা? যদিও একথাও জোর দিয়েই উচ্চারিত হয় যে, চুরি-দুর্নীতি-ধর্ষণ ইত্যাদি জঘন্যতম অপরাধের প্রবণতাও মানুষের ভেতর থাকে, কিন্তু সভ্য মানুষ এসব নেতিবাচক চরিত্রদোষ থেকে বেরিয়ে আসার চর্চা অব্যাহত রাখে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি এবং এই চর্চার নামই মনুষ্যত্ব কিংবা সভ্যতা, যে নামেই আমরা ডাকি না কেন।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে প্রায়শঃই পশ্চিম বিশেষ করে আমেরিকার ফর্মুলায় চলতে হয়, না চলতে পারলে বাধ্য করা হয়, বাধ্য করা না গেলে পায়ে পায়ে দোষ খুঁজে বের করে একের পর এক রিপোর্ট প্রকাশ করে তার সূত্র ধরে সেমিনার/সিম্পোজিয়াম করে বাংলাদেশকে চাপে রাখা হয়। অথচ বাংলাদেশ কখনও কাউকে আক্রমণ করতে যায়নি, কোনও দেশে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করেনি, অস্ত্র বিক্রি করেনি, লাখ লাখ মানুষ হত্যার কারণও হয়নি, উল্টো প্রতিটি বাঙালি তার নিজের থালা থেকে অন্ন ভাগ করে নিচ্ছে দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে। নিজেকে ‘দ্য ল্যান্ড অব দ্য ফি’ দাবি করা দেশটিতে ২০১৮ সালে শুধুমাত্র কালো বা আফ্রো-ক্যারিবীয়দের ওপর ১৯৪৩টি বর্ণবাদী আক্রমণের ঘটনা ঘটে, এর মধ্যে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে কালো নাগরিকের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা আলাদা করা না হলেও নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই সংখ্যা নেহাত কম হবে না। এর সঙ্গে যদি হিসপানিক, ভারতীয়, পাকিস্তানি, চায়নিজ, বাঙালি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণের ঘটনা যোগ করা যায় তাহলে সংখ্যাটি কত হতে পারে? হিসাব কষে কী হবে বলুন? সংখ্যা দিয়ে আজকাল কিছুই হয় না।
এই জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যা-পরবর্তী ঘটনাই লক্ষ করুন, কী দেখতে পান? আমেরিকা বিভক্ত হয়ে পড়েছে, একদল মানুষ হত্যা-পরবর্তী প্রতিবাদ ও প্রতিবাদকারীদের কারও কারও হঠকারী লুটপাটের ঘটনাকে ইস্যু করে এই হত্যাকাণ্ডকেই জায়েজ করতে চাইছেন। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সুরও কোথায় যেন এই বর্ণবাদীদের কণ্ঠে সাহস জোগাচ্ছে। ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কিংবা সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতিবাদী কণ্ঠ চাপা পড়তে বসেছে। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে চলা প্রতিবাদকালে সাংবাদিক নির্যাতনের সংখ্যা কত? একজন নারী সাংবাদিক পুলিশের হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে একটি চোখ হারিয়েছেন। এইতো বর্ণবাদবিরোধী পৃথিবীর অবস্থা। যদিও সারা পৃথিবীতে এখন #BlackLivesMatter প্রতিবাদ চলছে, কিন্তু ক’দিন এই প্রতিবাদ টিকবে? আর অর্জনইবা তাতে কী হবে? কতটা এগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র বর্ণবাদ ও দাসপ্রথার বিরুদ্ধে ঘটা গৃহযুদ্ধের পরে? কত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে একজন কালো প্রেসিডেন্ট পেতে আমেরিকাকে? এখন পর্যন্ত একজন নারীকে আমেরিকা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত করার উদারতা(?) দেখাতে পারেনি, অথচ নারী-পুরুষ সাম্যের গল্পে আটলান্টিক ভেসে যায়।
এমনটাই হয়, পৃথিবীময় বর্ণবাদী মানুষের সংখ্যা যে আসলেই অনেক তা পূব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ যেকোনও দেশেই যাওয়া যাক না কেন, প্রমাণ হাতেনাতেই পাওয়া যাবে, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। মনের ময়লা সাফ না করেই শরীরের রঙ নিয়ে আমরা প্রকাশ্যে এবং গোপনে বর্ণবাদের চর্চা করে যাই। সমাজ এতে তেমন কিছুই মনে করে না, পরিবারেও শিশুকাল থেকে এই শিক্ষা খুব কমই দেওয়া হয়ে থাকে যে, শরীরের রঙ/ধর্ম/জাত ইত্যাদির কারণে কাউকে ছোট করা কিংবা আক্রমণ করা যাবে না। ফলে মানুষ দিনের পর দিন অন্য অনেক নেতিবাচক চর্চার সঙ্গে আমৃত্যু লালন করে যায় বর্ণবাদ-তা শরীরের রঙের হোক, হোক সেটা ধর্মের কারণে ঘৃণা কিংবা হোক নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দাবি করে জাত-পাতের বড়াই। মুখে যদিও মানুষ বলে ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবারই সমান রাঙা’ কিন্তু অন্তরে ও আচরণে মানুষের ভেতর এই বর্ণবাদ নামক রোগ মহামারির মতোই আতঙ্কজনকভাবে বিদ্যমান।
করোনাভাইরাস প্রতিষেধক টিকা এক সময় না এক সময় আবিষ্কার হবেই, যেমন এর আগে আবিষ্কার হয়েছে কলেরা, যক্ষ্মা, বসন্ত ইত্যাদির প্রতিষেধক বা টিকা। হয়তো আরও বছরখানেক বা তারও কম সময়ে এর প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কৃত হবে, মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, মহামারিমুক্ত পৃথিবীতে আবার জন্ম নেবে নতুন প্রাণ, সচল হবে অচল যা কিছু। কিন্তু এই শত বছর বয়সী বর্ণবাদ নামক মহামারির টিকা কি আমরা আবিষ্কার করতে পেরেছি? পারিনি। পারার লক্ষণও কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
এইতো মাত্র গেলো সপ্তাহে, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নয়া উদ্যোগ ‘দ্য গ্রেট রিসেট’ (মহাপুনর্নির্মাণ)-এর উদ্বোধনী আয়োজনে বক্তৃতা রাখতে গিয়ে ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস স্যাব উদ্ধৃতি দিয়েছেন ২৭ বছর ধরে জেলখাটা একজন বর্ণবাদবিরোধী রাজনীতিবিদের, যার নাম নেলসন ম্যান্ডেলা। স্যাব বলেন, ‘একুশ বছর আগে আমি ডাভোসে একই মঞ্চে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে উপস্থিত ছিলাম যেখানে তিনি বলেছিলেন, আমাদের উচিত হবে বর্ণবাদের বর্শা এবং মানুষের মধ্যে ভেদাভেদের অস্ত্র ত্যাগ করা। এর জন্য প্রয়োজন হবে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, মানুষের সদিচ্ছা এবং সম্মিলনের সংস্কৃতি। এগুলোর কোনোটিই সম্ভবপর হবে না একটি শক্ত অর্থনীতির ভিত এবং একটি দৃঢ় সম্মিলনেচ্ছু সমাজব্যবস্থা ছাড়া।’ স্যাব তার বক্তৃতায় স্বীকার করেন, আমরা এখন যে সমাজব্যবস্থা কিংবা পৃথিবীতে বসবাস করছি তা অসামঞ্জস্যতায় ঠাসা, বিভক্ত এবং অন্যায্যতায় পরিপূর্ণ। করোনা নামক মহামারি আরও প্রমাণ করে দিয়েছে, এই পৃথিবী কোনোভাবেই একুশ শতকের উপযোগী পৃথিবী নয়, এখানে বর্ণবাদের মতো ভয়ংকর মহামারি রয়েছে, রয়েছে অর্থনৈতিক অসমতা, যুদ্ধবাজ রাজনীতি এবং মানুষের মৌলিক অধিকারের রয়েছে তীব্রতম ঘাটতি। স্যাব সহ এই সম্মেলনে অংশ নেওয়া ভুবনবিখ্যাত (যেমন ব্রিটেনের যুবরাজ বা হবু রাজা চার্লস, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ-এর প্রধান, প্রযুক্তি-দৈত্য মাইক্রোসফট-এর প্রেসিডেন্ট) ব্যক্তিগণ করোনা-পরবর্তী পৃথিবীর অর্থনীতি পুনর্নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে যে ক’টি শত্রুকে বিনাশ করার কথা বলেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো বর্ণবাদ, কিন্তু বাকি যেগুলো এর সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে সেগুলোও বর্ণবাদের বড়-মেঝ-সেজ-ছোট ভাই। আগ্রহী পাঠকের জন্য বাকিগুলোর নামও বলে দিচ্ছি: মেরুকরণ, জাতীয়তাবাদ এবং যুদ্ধ। দ্য গ্রেট রিসেট বা মহাপুনর্নির্মাণের মূল কাজই হবে অর্থনীতিকে নতুন মাত্রায় ফেলে এসব অপসর্গকে দূর করা।
নিঃসন্দেহে দারুণ উদ্যোগ, হয়তো কিছু ফলও আমরা দেখবো, যেমন দেখেছি এর আগে জাতিসংঘ কিংবা বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান গঠিত হওয়ার ফলে। কিন্তু তাতে পুরো বিশ্ব রাতারাতি বর্ণবাদমুক্ত হয়ে ‘সকল মানুষ সমান’ জাতীয় ‘সাম্যে’ ছয়লাব হয়ে যাবে, সে আশা কি কোনোভাবেই আমরা করতে পারি? পারি না, কারণ আমরা জানি, যদিও মানুষ বর্ণবাদী হয়ে জন্মায় না, কিন্তু ক্রমশ মানুষ বর্ণবাদী হয়ে ওঠে, পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র তাকে বর্ণবাদী করে তোলে। আর আমরা এও জানি, বর্ণবাদ নামক রোগের কোনও টিকা নেই, নেই কোনও প্রতিষেধকও, আছে কেবল প্রতিরোধ আর নিজেকে ক্রমাগত ‘মানুষ’ করে তোলার সংগ্রাম; আমরা প্রস্তুত আছিতো আমৃত্যু এই প্রতিরোধ-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে? এ বড় কঠিন সংগ্রাম, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই, কিন্তু মানুষের অসাধ্য শুনেছি কিছুই নেই।
লেখক: সাংবাদিক
Discussion about this post