জাকিয়া আহমেদ
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কান পাতলেই এখন শোনা যায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) জন্য স্বজনদের হাহাকার। সাধারণ মানুষের এই আর্তিতে বিব্রত হন চিকিৎসকরা। কেবল চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না তাদের। আইসিইউ বেডের অভাবে চোখের সামনে রোগীকে মরতে দেখার চিত্র এখন তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গেছে।
খোদ চিকিৎসকরাই পাচ্ছেন না আইসিইউ বেড। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন নিজের কর্মস্থলে আইসিইউ পাননি। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হলে গত ১৫ এপ্রিল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে মারা যান তিনি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন একই কারণে মারা গেছেন। তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা) হেড অব অ্যাকাউন্ট মো. মনিরুজ্জামান। লোকটি শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। নমুনা পরীক্ষায় তার শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। গত ২ জুন সন্ধ্যায় শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু হাসপাতালে কোনও আইসিইউ বেড নেই। এ কারণে বেসরকারি একটি হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে তোলার পরই তিনি মারা যান।
হৃদয়বিদারক ঘটনা আরও আছে। খন্দকার সাহিদুল ইসলাম নামের একজন শ্বাসকষ্ট নিয়ে গত ২১ মে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে তার শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। ১০ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ৩১ মে রাতে তিনি মারা যান। তার ভাই খন্দকার মনিরুল ইসলাম সোহেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিকিৎসকরা তাকে বারবার আইসিইউতে নেওয়ার জন্য বলেছিলেন। গত ২৫ মে থেকে চেষ্টা করেছি, অনেক মানুষের কাছে ধরনা দিয়েছি। শেষের দিকে চিকিৎসকরা নিজেরাও আইসিইউর জন্য দৌড়াদৌড়ি করেছেন, তবুও পাওয়া যায়নি। তারা খুবই আন্তরিক ছিলেন, এটাই একমাত্র ইতিবাচক দিক দেখলাম। বাকি সবকিছুতে গলদ। আইসিইউর অভাবেই মারা গেছে আমার ভাই। ডাক্তাররা লিখে দিলেন— অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু আইসিইউ ব্যবস্থা করা যায়নি।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, করোনা রোগীদের শতকরা ৮০ শতাংশের মধ্যে মৃদু লক্ষণ দেখা দেয়। তাদের হাসপাতালে যেতে হয় না। বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে ১৫ শতাংশের উপসর্গ তীব্র হয় এবং হাসপাতালে যেতে হয়। আর বাকি ৫ শতাংশের অবস্থা থাকে জটিল। তাদের আইসিইউ বেডের পাশাপাশি দরকার হয় ভেন্টিলেটর।
অবশ্য বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, সাধারণত বৃদ্ধ ও আগে থেকেই অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্তদের আইসিইউ প্রয়োজন হয়। অথচ প্রতিটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে একটি আইসিইউ শয্যা পেতে অপেক্ষায় থাকতে হয় একাধিক রোগীকে। আইসিইউ না পেয়ে রোগী মারা যাওয়ার চিত্র তো প্রায় প্রতিদিনের।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে করোনা রোগীর জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড রয়েছে ৩৯৯টি। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ২১৮টি। ঢাকা বিভাগের অন্য জেলায় রয়েছে ৪৭টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৭টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৪টি, রাজশাহী বিভাগে ২৮টি, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে ১৮টি করে, সিলেট বিভাগে ১৬টি এবং রংপুর বিভাগে রয়েছে ১৩টি আইসিইউ বেড।
রাজধানীতে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে ২৬টি, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২৭টি, মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ১০টি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৪৮টি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১৬টি, রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় ৩টি করে, সাজিদা ফাউন্ডেশনে ৪টি, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০টি, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল এবং মিরপুরের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতালে ৫ শয্যার আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের কাজ চলছে। কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এছাড়া পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার জন্য তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় অবস্থিত বেসরকারি ইমপালস হাসপাতালে রয়েছে ১৪টি আইসিইউ।
কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের অ্যানেস্থেশিয়া বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. চন্দন কুমার বণিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখানে আইসিইউ বেড ফাঁকা থাকে না বললেই চলে। একেকটি বেডের জন্য অপেক্ষায় থাকেন একাধিক রোগী। কেউ সুস্থ হয়ে কেবিনে গেলে কিংবা মারা গেলে অপেক্ষারতদের মধ্য থেকে তুলনামূলক যার অবস্থা বেশি নাজুক তাকেই নিয়ে আসা হয় আইসিইউতে।’
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার ডা. আসাদুল মজিদ নোমানের দাবি, এখানে প্রতিটি আইসিইউর জন্য ভীষণ চাপ থাকে। নিদেনপক্ষে একেকটি বেডের জন্য অপেক্ষায় থাকেন পাঁচজন করে। তারা কিছুক্ষণ পরপর বেড খালি হয়েছে কিনা জানতে চান।
ডা. আসাদুল মজিদ নোমানের কথায়, ‘কী সব মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যে আমরা যাচ্ছি জানেন না। একজন রোগীর ডেথ সার্টিফিকেট লেখা শেষ না হতেই আরেকজনকে আনা হয়। তার অবস্থা এতই নাজুক ছিল যে, আইসিইউতে আনার পর তার চিকিৎসা শুরু করতে না করতেই মারা গেছেন।’
আগামীতে আইসিইউ সংকট প্রকট হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য। তার মন্তব্য, ‘দেশে আগে থেকেই আইসিইউর সংকট ছিল। গত কয়েক সপ্তাহে রোগী যেমন বেড়েছে, তেমনই বাড়ছে আইসিইউর চাহিদা।’
বিএসএমএমইউ’র সাবেক উপাচার্যের পরামর্শ, ‘হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড ও অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। মৃত্যু কমাতে এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই।’
তবে রাতারাতি আইসিইউ বেড বাড়ানো সম্ভব নয়। এটাই বাস্তবতা উল্লেখ করেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও করোনা বিষয়ক মিডিয়া সেলের প্রধান হাবিবুর রহমান। তার মন্তব্য, ‘এখন যা উপকরণ আছে সেসবই ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া বিদেশ থেকে যা যা পারা যায় তা আনার প্রক্রিয়া চলছে।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘যত আইসিইউ বেড আছে সেগুলোর পূর্ণ সদ্ব্যবহার যাতে হয় তা নিশ্চিতের চেষ্টা করা হচ্ছে। সেটি হলেও অন্তত ৪০০ মানুষ সেবা পাবে।’
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ— ‘যেহেতু আইসিইউর ঘাটতি রয়েছে, তাই রোগীদের জটিল অবস্থা হওয়ার আগে তাদের দিকে নজর দিতে হবে। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াতে হবে।’
জীবাণুর সংক্রমণ যাতে না হয় সেদিকে জোর দেওয়ার আহ্বান জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোগী যত কম হবে, ঝুঁকি ততই কমবে। পাশাপাশি আইসিইউর মতো জটিল ব্যবস্থাপনার আগে যদি সহজ ব্যবস্থাপনা নেওয়া যায় তাহলে জটিলতার দিকে রোগী কম যাবে।’ সুত্র – বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post