| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধির পর যেসব সাধারণ ওষুধ মিলতো সব ফার্মেসিতেই, হঠাৎ করে সেসব ওষুধ বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে ওষুধের পাইকারি বাজার হাজারি গলিতেও পাওয়া যাচ্ছে না এসব ওষুধ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাড়ানো হয়েছে বেক্সিমকোর নাপা, স্কয়ারের ফেক্সো, জিমেক্স, সিভিট ট্যাবলেটের দাম। এই তালিকায় আছে অ্যান্টিহিস্টামিন, অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন জাতীয় ওষুধসহ জীবাণুনাশক সামগ্রীও।
ফার্মেসি মালিকরা জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে প্যারাসিটামল, অ্যান্টিহিস্টামিন, অ্যান্টিম্যালেরিয়াল, ভিটামিন সি ট্যাবলেট ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন জাতীয় ওষুধের বিক্রি কয়েকগুণ বেড়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ওইসব ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, করোনা ভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়াসহ মৌসুমি জ্বর ইনফ্লুয়েঞ্জা। এ অবস্থায় চিকিৎসকদের চেম্বার বন্ধ থাকায় এবং অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি করতে অনীহার কারণে অনেকে ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতার স্মরণাপন্ন হচ্ছেন। পাশাপাশি চলছে টেলিমিডিসিন সেবাও। আবার অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া চিকিৎসকের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে জেনে নিচ্ছেন তার রোগের ওষুধের নাম। এছাড়া অনেক চিকিৎসক করোনা সহ নানান রোগের জন্য রোগীকে কি কি ওষুধ খাওয়াতে হবে- তার বিবরণ সমেত প্রেসক্রিপশন স্ক্যান করে তুলে দিচ্ছেন ফেসবুকে।
ডা. আলম নামের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, অ্যান্টিপ্রোটোজোয়াল মেডিসিন ইভারমেকটিনের সিঙ্গেল ডোজের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ডক্সিসাইক্লিন প্রয়োগে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মাত্র তিন দিনে ৫০ শতাংশ লক্ষণ কমে যাওয়া আর চার দিনে করোনা ভাইরাস টেস্টের রেজাল্ট নেগেটিভ আসার বিস্ময়কর সাফল্য পেয়েছেন। এরপর এ ওষুধ কিনতে ক্রেতাদের আগ্রহ বেড়ে যায়।
করোনা ভাইরাসজনিত রোগের (কোভিড-১৯) এখন পর্যন্ত নিশ্চিত কোনো ওষুধ না থাকলেও অনেক চিকিৎসক ফেসবুক লাইভে এসে জানিয়েছেন, ট্যাবলেট ইভারমেকটিন (৬ মিলিগ্রাম) রোগীর ওজন ৬০ কেজির নিচে হলে ২টি একসঙ্গে খালি পেটে খেতে হবে। আর ওজন ৬০ কেজির ওপরে হলে ৩টি ট্যাবলেট একসঙ্গে ১ বার খেতে হবে। এই ট্যাবলেট বাজারে স্ক্যাবো, ইভরা, প্যারাকিল ইত্যাদি নামেও পাওয়া যায়। ওজন ৪০ কেজির ওপরে হলে ট্যাবলেট ফ্যাভিপিরাভির (২০০ মিলিগ্রাম) সকালে ৮টি ও রাতে ৮টি ১ম দিন, পরবর্তীতে সকালে ৩টি ও রাতে ৩টি করে ৭-৯ দিন খেতে হবে। এই ট্যাবলেট বাজারে অ্যাকারভিয়া, ফ্যাভিপিরা, অ্যাভিগান ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। ম্যালেরিয়ার ওষুধ ট্যাবলেট হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন বাজারে পাওয়া যায় রিকোনিল সহ বিভিন্ন নামে। সহজেই এই প্রেসক্রিপশন পেয়ে করোনার উপসর্গ থাকা অনেকে ওষুধ সংগ্রহ করছেন।
জানা গেছে, দেশীয় কোম্পানিগুলোকে করোনার পরীক্ষামূলক বেশ কয়েকটি ওষুধ তৈরির অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এদের মধ্যে আছে- এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, জিসকা ফার্মাসিউটিক্যালস, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস প্রভৃতি। এর বাইরে এসব কোম্পানির অন্য ওষুধের সরবরাহ স্বাভাবিক আছে।
সম্প্রতি করোনাজয়ী চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের রেজিস্টার ডা. লক্ষ্মীপদ দাশ বলেন, করোনার চিকিৎসা একটি গাইডলাইন অনুসারে চলে। কিন্তু অনেকে স্ক্যাবো ট্যাবলেট ও ডক্সিসাইক্লিন ক্যাপসুলসহ নানান ওষুধ ফার্মেসি থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এসব ওষুধ করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় কার্যকর বলে এখনও প্রমাণিত হয়নি।
এদিকে এই সুযোগে ওষুধের দোকানীরাও হাতিয়ে নিচ্ছেন অধিক দাম। নগরের একটি স্থানীয় দৈনিকের অফিস সহায়ক মোরশেদ কামাল বাংলানিউজকে বলেন, এক পাতা স্ক্যাবো ট্যাবলেট (৬ মিলিগ্রাম) এর দাম ছিল ৫০ টাকা। এখন সেই ওষুধের দাম নেওয়া হচ্ছে সাড়ে ৪শ-সাড়ে ৬শ টাকা।
আবু বকর সিদ্দিকী (৬৬) নামের একজন হৃদরোগী বাংলানিউজকে বলেন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বুকে ব্যথা, চর্বি নিয়ন্ত্রণ, শরীরের বাড়তি পানি কমানোর জন্য ব্যবহার করা ওষুধ অ্যাসপ্রিন, ডিলটিয়াজেম, গ্লিক্লাজাইড, গ্লিবেনক্লামাইড, আইসোসরবিড, লিসোনোপ্রিল, নাইট্রোগ্লিসারিন, পটাশিয়াম ক্লোরাইড, রেমিপ্রিল, ফেনোফিব্রেট ক্যাপসুলের দাম আগের তুলনায় বেশি রাখা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ওষুধ বিক্রেতা জানান, নগরের জামাল খান, পাঁচলাইশ, চমেক হাসপাতাল এলাকার ফার্মেসিগুলোতে এসব ওষুধের গলাকাটা দাম নেওয়া হচ্ছে। প্রচারমাধ্যমে করোনা ঠেকাতে ভিটামিন সি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়ার পর সিভিট ট্যাবলেটও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হাজারী লেইনে ফ্যামিলি সাইজ ১ হাজার এমএল স্যাভলন ২২০ টাকার স্থলে নেওয়া হচ্ছে ৫শ-৭শ টাকা। ফার্মেসির বাইরেই চলছে নিম্নমানের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী বেচাকেনা। ফার্মেসিতে ওষুধ কেনার পর বিক্রয় রশিদও দেওয়া হচ্ছে না।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ গঠিত কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক ডা. আ ন ম মিনহাজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে সেবনের ফলেই মানুষ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। করোনার চিকিৎসা একমাত্র চিকিৎসকদের গাইডলাইন মেনেই চালাতে হয়। শুনে শুনে অনেকে ইভারমেকটিন খেয়েছেন। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, সামাজিক মাধ্যমে দেখে ওষুধ কিনে খেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারও শরীরের সর্বনাশ ডেকে আনছে। শুধু ট্যাবলেট-ক্যাপসুলের ওপর নির্ভর না করে এ সময়ে ভিটামিন সি জাতীয় ফল বেশি খাওয়া যেতে পারে।
Discussion about this post