শাহেদ শফিক, বাংলা ট্রিবিউন
দেশের পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যাত্রী অধিকার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের কঠোর সমালোচনা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তা-ব্যক্তিদের নানা হুঁশিয়ারির মধ্যেও বিশৃঙ্খল পরিবেশে চলতো খাতটি। কিন্তু এবার সেই চাঁদাবাজি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। তারা বলছেন, যে করেই হোক পরিবহন খাতের দুর্নাম তারা ঘোচাবেন। এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গণপরিবহন থেকে সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিবহন সেক্টরের প্রধান তিনটি সংগঠন যৌথ বৈঠক করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি তাদের অধীনস্থ অন্যান্য সব সংগঠনগুলোকে পত্র দিয়ে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাস টার্মিনাল, সড়ক, মহাসড়ক বা অন্য কোথাও যানবাহন থেকে কোনও প্রকার চাঁদা আদায় করা যাবে না। এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, গত ২৯ মার্চ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাজাহান খান, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ ও সেক্রেটারি আবু রায়হানের নেতৃত্বে এক যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় চাঁদাবাজি বন্ধে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ১ জুন থেকে সড়ক পরিবহন খাতে কোনও যানবাহন হতে সড়ক-মহাসড়ক ও বাস-ট্রাক টার্মিনালে বা অন্য কোথাও কোন ধরনের অবৈধভাবে চাঁদা উত্তোলন করা যাবে না। মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে সদস্য চাঁদা নিজ নিজ অফিস থেকে সংগ্রহ করা যাবে। এই বিধানের কোনও ব্যত্যয় ঘটলে বিধান লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় মালিক ও শ্রমিক সংগঠন থেকে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও কোনও সংগঠন বা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নামেও যদি চাঁদাবাজি হয় তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সারাদেশে বিভিন্ন কোম্পানির নামে পরিচালিত যানবাহন পরিচালনার ক্ষেত্রে অনিয়ম পরিহার চাঁদাবাজি বন্ধ এবং দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি ভাড়া দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এই বিধানের কোনওরূপ ব্যত্যয় ঘটলে সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিবহন চলাচলের ক্ষেত্রে গাড়ির যাত্রা শুরু ও যাত্রা শেষ প্রান্তে খরচ নির্বাহের জন্য নুন্যতম অর্থ যা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের অনুমোদন সাপেক্ষে সংগ্রহ করা যাবে। নির্ধারিত স্থান ব্যতীত জেলা বা উপজেলার কোনও শাখা বা উপকমিটি কোনও ধরনের অর্থ আদায় করতে পারবে না।
এদিকে সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ৪ জুন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সব পরিবহন কোম্পানি, রুট মালিক সমিতি, টার্মিনাল মালিক সমিতিসহ তার সংগঠনের অধীনস্থ সকল মালিক সমিতিগুলোকে বাস থেকে চাঁদা না তোলার জন্য পত্র দেন। তাতে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, দেশের করোনাভাইরাস জনিত রোগ বিস্তার রোধে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সিটের অর্ধেক যাত্রী নিয়ে যানবাহন পরিচালনাসহ যাত্রীদের নিকট থেকে সরকার নির্ধারিত বর্তমান ভাড়া ৬০ শতাংশের বেশি আদায় করা যাবে না। এছাড়া টার্মিনাল, সড়ক-মহাসড়ক বা অন্য কোথাও যানবাহন থেকে কোনও প্রকার চাঁদা আদায় করা যাবে না। এ ব্যাপারে কোনও অভিযোগ পাওয়া গেলে চাঁদা আদায়কারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, আপনারা জানেন অবৈধ চাঁদাবাজির কারণে দেশের পরিবহন খাতের মালিক ও শ্রমিক নেতারা বর্তমানে সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে। পাশাপাশি সড়ক পরিবহন খাতে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। তাই আমরা পরিবহন সেক্টরের সব সংগঠন ও নেতারা একত্রিত হয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যারা অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে মঙ্গলবার (৯ জুন) বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙা ও মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ এক বিবৃতিতে জানান যে, গত ২৯ মে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন উভয়ই আমরা একমত হই যে, মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে কোথাও কোনও প্রকার চাঁদা উত্তোলন করা যাবে না। এই মর্মে আমরা তিন সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি রেজুলেশন করে সারা দেশের পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কাছে প্রেরণ করেছি।
পরবর্তীতে গত ৪ জুন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ এবং পুলিশের আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদসহ পুলিশ সদর দফতরে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটির কথা আগ থেকে আমাদের জানা না থাকায় আমরা ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারিনি। আমাদের আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেই বৈঠকে সারাদেশের পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধের জন্য পুলিশের আইজিপি সাহেব যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেই নির্দেশনার সাথে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে আমরা সম্পূর্ণ একমত।
এতে আরও বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে আমরা পরিবহন সেক্টরে চাঁদা বন্ধ করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে কোথাও কোথাও আমরা নিজেরাও অপপ্রচারের সম্মুখীন হয়েছি। চাঁদাবাজি বন্ধ করে পরিবহন সেক্টরকে চাঁদা মুক্ত করার পক্ষে আমরা আশাবাদী। সারাদেশে পরিবহনে চাঁদা বন্ধের ব্যাপারে পুলিশের আইজিপি যে নির্দেশনা দিয়েছেন তার সঙ্গে একমত হয়ে আমরা এজন্য পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছি।
Discussion about this post