বিশেষ প্রতিবেদক
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সবারই ধারণা ছিলো হয়তো মাস দুমাস পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিস্তু প্রতিদিনের ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার সে আশার গুড়ে বালি ঢেলে দিয়েছে।সরকার কোমলমতি শিশু-কিশোর এবং তরুণদের জীবন নিয়ে কোনপ্রকার ঝুঁকি নিতে চায়না।তাই করোনার তান্ডব না থামা পর্যন্ত সরকারী বেসরকারী কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষক কর্মচারীগণের বেতনভাতা পরিশোধে ক্রমেই অক্ষম হয়ে পড়েছে।প্রথম ১মাস কোনমতে চালিয়ে নিলেও পরবর্তীতে আর বেতন দেয়া সম্ভব হয়নি। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান আয় টিউশন ফি আদায়ে তৎপর হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এই মুহূর্তে বেশির ভাগ অভিভাবকই টিউশন ফি দিতে অপারগ কিংবা নারাজ। এ নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালক ও অভিভাবকগণের মধ্যে চলছে নানা বিতর্ক ও টানাপোড়েন।
মূলত: করোনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় আছে দেশের অর্ধলক্ষ কিন্ডারগার্টেন স্কুল। সেগুলোর বেশির ভাগেই আয়-রোজগার খুব বেশি নয়। শিক্ষকরাও সামান্য টাকা বেতন পান। কিন্তু মার্চ মাস থেকেই এসব স্কুলে টিউশন ফি আদায় একপ্রকার বন্ধ রয়েছে। শিক্ষকরাও বেতন পাচ্ছেন না। এ ছাড়া মফস্বল পর্যায়ের প্রায় সাত হাজার নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আর এসব স্কুলের শিক্ষকদের আয় ছিল মূলত: প্রাইভেট-টিউশনি নির্ভর। কিন্তু মার্চ মাস থেকে প্রাইভেট-টিউশনি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের আয়-রোজগারও বন্ধ হয়ে গেছে।
অভিভাবকদের যুক্তি টিউশন ফি নির্ধারিত হয় মূলত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন, বিভিন্ন ধরনের বিল পরিশোধসহ নানা কাজের জন্য। কিন্তু করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বেতন-ভাতা বাদে প্রতিষ্ঠানের তেমন কোনো খরচ ছিল না। যেসব অভিভাবক বেসরকারি চাকরি ও ছোট ব্যবসা করেন, তাঁরা সমস্যায় আছেন। এই অবস্থায় শতভাগ বেতন আদায় করা কোনো যুক্তির মধ্যে পড়ে না। আর যেসব স্কুলের ফান্ড রয়েছে, তাদের তো কয়েক মাস বেতন না নিলেও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
একজন অভিভাবক বলেন, বাচ্চা স্কুলেই গেল না, তাহলে শতভাগ বেতন পরিশোধ করাটা কি কোনো যুক্তির মধ্যে পড়ে?’অথচ অনেক অভিভাবক পুরো মাস চাকরি করেও বেতন পাচ্ছেন না। এমনকি অনেক বেসরকারি চাকুরের একাধিক মাসেরও বেতন বাকি।ছোটবড় সব ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ, তাদেরও কর্মচারীর বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের যুক্তি, টিউশন ফি আদায় করেই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়। খুব কম প্রতিষ্ঠানই আছে যাদের বছর শেষে টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। বর্তমান অবস্থায় টিউশন ফি পাওয়া যাচ্ছে না বলেই শিক্ষকদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। তবে যাঁরা সচ্ছল অভিভাবক তাঁরা যদি সবাই বেতন পরিশোধ করে দিতেন, তাহলে যাঁরা সত্যিকার অর্থেই সমস্যায় আছেন তাঁদের ব্যাপারে ভাবতে পারত প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।
প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের এই মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যে গত সোমবার সারা দেশে এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন আদায় কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়েছে। আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থীর অভিভাবকের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. সাইফুর রহমান আবেদন করেছেন। রিট আবেদনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি), দেশের সব শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান (মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক) ও আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষকে বিবাদী করা হয়েছে।
গত এপ্রিলের শেষ দিকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে এক আদেশে টিউশন ফি আদায়ে চাপ প্রয়োগ না করার জন্য প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের বলা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিলে বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে বকেয়াসহ মাসিক বেতন আদায়ের অনুরোধ জানানো হয় আদেশে। এ ছাড়া শিক্ষার আর কোনো দপ্তর থেকে টিউশন ফি আদায়ের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আর কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠানই আছে, যারা শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি দিয়েই চলে। এখন যদি আমরা টিউশন ফি আদায় বন্ধ করে দিই, তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কিভাবে চলবেন? আবার অভিভাবকদের কথাও ভাবতে হচ্ছে। তাই আমি আবারও বলব, যাঁরা এই মুহূর্তে টিউশন ফি দিতে পারছেন না, তাঁদের যেন চাপ দেওয়া না হয়।’
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘ম্যানেজিং কমিটি বাণিজ্য করতে অনেক এমপিওভুক্ত স্কুলে অযথাই অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ দেয়। এসব স্কুল টিউশন ফি আদায়ে চাপ দিচ্ছে। আবার অনেক স্কুলের ফান্ডে টাকা থাকার পরও চাপ দিচ্ছে। আমাদের দাবি, মার্চ মাস থেকে আগস্ট পর্যন্ত সব স্কুলের শতভাগ টিউশন ফি মওকুফ করতে হবে। এতে যেসব স্কুল সত্যিকার অর্থে সমস্যায় পড়বে তাদের জন্য সরকারের প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এই দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে।’
রাজধানীর মনিপুর স্কুলের অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় করেই আমাদের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হয়। এ জন্যই আমরা মানবিক আবেদনের মাধ্যমে বেতন-ভাতা চাচ্ছি। কিন্তু এতে অভিভাবকদের তেমন একটা সাড়া নেই। সব অভিভাবক তো আর অসচ্ছল না।সরকারী চাকুরেরাতো নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন। কিন্তু এর পরও টিউশন ফি পরিশোধ করছেন না। আমরা শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের অর্ধেক বেতন দিয়েছি। আর মে মাসের বেতন এখনো দিতে পারিনি।’
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ফওজিয়া বলেন, ‘আমরা শুধুমাত্র জানুয়ারি মাসের বেতন নিয়েছিলাম। আবার মার্চে বেতন নেওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। তবে আমরা এখন একসঙ্গে আরো দুই মাসের বেতন নেব। তবে আমাদের ফান্ড থেকে শিক্ষকদের সকল বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছি। করোনার এই সময়ে আমরা অনলাইনে ছয় শতাধিক ক্লাস নিয়েছি। তার পরও অভিভাবকদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে বেতন নেওয়া বন্ধ রেখেছিলাম।’
সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিউশন ফি নির্ভর। আমি অভিভাবকদের অনুরোধ করব, তাই তাঁরা যেন টিউশন ফির ব্যাপারটা বিবেচনা করেন। তবে যাঁরা সমস্যায় রয়েছেন তাঁদের কথা ভিন্ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকেও বলব, প্রয়োজনে কিছুটা ফি কম নেওয়া বা কিস্তিতে ফি নেওয়ার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে; যার মধ্য দিয়ে অভিভাবকরাও কিছুটা স্বস্তি পেলেন। কেউ বড় আকারের কোনো সমস্যায় পড়লেন না।’
বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জি এম নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘ছোট স্কুলগুলো বেশি সমস্যায় পড়েছে। ফলে অনেক স্কুলেরই বাড়িভাড়া, শিক্ষকদের বেতন বাকি পড়ে আছে। এভাবে চললে কিছু স্কুল বন্ধও হয়ে যাবে। আর জুন মাসে যেহেতু সেশন শেষ হচ্ছে, তাই স্কুলগুলো টিউশন ফি আদায়ের চেষ্টা করছে। আমি সচ্ছল অভিভাবকদের অনুরোধ করব, তাঁরা যদি টিউশন ফি দিয়ে দেন তাহলে যাঁরা অসচ্ছল আছেন তাঁদের ব্যাপারটা বিবেচনায় আনা যায়।’
তবে করোনার এই দুর্যোগের মধ্যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে মাস্টারমাইন্ড স্কুল। তারা মার্চ মাস পর্যন্ত পূর্ণ বেতন গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এপ্রিল, মে ও জুন মাসের বেতন অর্ধেক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে অনেক অভিভাবকই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন।
অভিভাবক এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ উভয়েই সহযোগী মনোভাবাপন্ন হয়ে এগিয়ে এলেই কেবল এ সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন অভিজ্ঞজনেরা।
Discussion about this post