বিশেষ প্রতিবেদক
চট্টগ্রামের একজন ‘রত্নগর্ভা মা’ মোছাম্মৎ জোহরা বেগমের চিরবিদায় ঘটেছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানসহ ছয় সন্তানের গর্বিত জননী জোহরা বেগম বুধবার গভীর রাতে নগরীর পাঁচলাইশ থানা সংলগ্ন বাসভবনে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কিছুদিন ধরে তার মা প্যারালাইসিস, ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। বাসায় রেখে তাকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছিলো। মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টার দিকে তিনি বাসায় মারা যান। গতকাল বুধবার সকাল এগারটায় চন্দনাইশের বরকলস্থ গ্রামের বাড়িতে নামাজে জানাজা শেষে মরহুমাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। জানাজায় স্থানীয় বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
চন্দনাইশের বরকলের মরহুম ডাক্তার আবদুল মতিনের সংসার আলোয় আলোয় ভরে দেয়ার নেপথ্য কারিগর, পরহেজগার, দানশীল এবং মানবিক মানুষ জোহরা বেগম চার পুত্র এবং দুই কন্যা সন্তানের জননী। ছয় সন্তানের ‘নয়নের মণি’ হিসেবে জীবন অতিবাহিত করা এই মা আক্ষরিক অর্থেই একজন প্রকৃত রত্নগর্ভা ছিলেন। উনার ছয় সন্তানের প্রত্যেকেই উচ্চ শিক্ষিত, দেশের গর্ব। বিশ্বের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটিতে যেমন উনার সন্তান পড়েছেন, তেমনি পড়াচ্ছেন পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ অক্সফোর্ডে।
অর্থ যশ ক্ষমতা সবই খুব কাছ থেকে দেখলেও অতি নিরহংকারী এই মানবী ছিলেন মাটির কাছাকাছি। নিজ এলাকা এবং ধারেকাছের মানুষদের প্রতি অগাধ মমত্বের লালন করতেন। ছয় সন্তানই দেশে বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও মায়ের কথা ছাড়া কেউই বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন না। মা যেন সন্তানদের চোখের মণি। মাকে ভালোবাসা এমনকি ভাত খাইয়ে দেয়ার জন্যও সন্তানদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো এই সংসারে। আলোয় আলোয় ভরে থাকা সেই সংসারটি গতকাল থেকে মায়ের ছায়া হারিয়ে ফেললো। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান মা’হীন হয়ে যাওয়ার কষ্টের কথা বলতে গিয়ে শুধু মায়ের জন্য দোয়া চাইলেন।
ছয় সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান ড. হাসান জিল্লুর রহিম আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিসকোর সিলিকন ভ্যালিতে প্রযুক্তিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তিনি বেশ সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। দ্বিতীয় সন্তান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারম্যান। ডা. মহসিন জিল্লর করিম এবং ডা. প্রফেসর তাহমিনা বানু দুজনই চিকিৎসক হিসেবে অত্যন্ত সফল। চট্টগ্রামে প্র্যকটিস করলেও দুজনই বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা বিদ্যাপীঠ অঙফোর্ডের অনারারী অধ্যাপক। অপর ভাই অধ্যাপক আদনান মোর্শেদ আমেরিকার ওয়াশিংটনের দ্য ক্যথলিক ইউনির্ভাসিটিতে আর্কিটেক্টচার এন্ড আর্কিটেক্টচারাল হিস্ট্রির অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। দেশের শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ এবং বুয়েট থেকে পাশ করে তিনি পৃথিবীর সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমআইটি থেকেও ডিগ্রি লাভ করেন। আমেরিকায় শিক্ষকতায় তিনি বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। ছোট বোন আদিনা বানু ঢাকায় একজন উদ্যোক্তা হিসেবে সফলতা লাভ করেন।
এক মায়ের ছয়টি সন্তানের সবাই সফল হওয়ার নজির খুব বেশি নেই। চট্টগ্রামের জোহরা বেগমের ছয় সন্তানই সফলতা লাভ করে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। বিভিন্ন সময় তাঁকে চট্টগ্রামের রত্নগর্ভা হিসেবে নানা প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মানিত করা হয়েছে। চট্টগ্রামের প্রকৃত এই রত্নগর্ভার চিরবিদায় গতকাল বহু মানুষকেই বিমর্ষ করেছে।
Discussion about this post