হাসান আকবর, দেনিক আজাদী
ঢাকায় পাঠানো চট্টগ্রামের তিন হাজার রিপোর্টের আংশিক এসেছে। নমুনা পাঠানোর প্রায় দুই সপ্তাহ পর আংশিক রিপোর্ট এলেও বাকি রিপোর্ট কবে আসবে তা কেউ জানে না। চট্টগ্রামের তিন হাজার নমুনা গত ৭ এবং ৮ জুন পাঠানো হয়েছিল ঢাকায়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এবং ফৌজদারহাটস্থ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) এর সংগৃহীত এ নমুনার বাকিগুলোর রিপোর্টের কোন খবর না থাকলেও প্রতিদিনই নমুনার পাহাড় গড়ে উঠছে। লোকবল সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতায় সরকারিখাতে করোনা পরীক্ষা নিয়ে মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। বেসরকারিখাতে দুইটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়া হলেও একটি কাজ শুরু করতে পারেনি। অপরটিও চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। চট্টগ্রামে টাকা খরচ করেও নমুনা পরীক্ষা কিংবা করোনার রিপোর্ট পাওয়া এখন ভাগ্যের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, করোনা সংক্রমণ এবং মৃত্যুতে ঢাকাকে ছাড়িয়ে যাওয়া চট্টগ্রামে ইতোমধ্যে ছয় হাজারেরও বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে ১৪০ জন। প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। করোনার ভয়াবহ সামাজিক সংক্রমণে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা দেড়শ’র নিচে থাকলেও করোনা উপসর্গ এবং পরীক্ষা করানোর সুযোগ বঞ্চিত মৃতের সংখ্যা বহু বেশি। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। করোনাকালের মৃতদেহ দাফন কাফন এবং সৎকারে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে মৃতের সংখ্যা আটশ’রও বেশি। করোনা আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ার কথা স্বীকার করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। তবে পরীক্ষা করাতে না পারায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। গত ২ জুন নমুনা দিয়েছেন এমন বহু মানুষ গতকাল পর্যন্ত রিপোর্ট পাননি।
ইতোমধ্যে এদের কেউ কেউ সুস্থ হয়ে গেছেন। কেউবা চলে গেছেন পরপারে। চট্টগ্রামে করোনার নমুনা পরীক্ষার সুযোগ সীমিত হওয়ায় মানুষের ভোগান্তিও বাড়ছে। নমুনা সংগ্রহের বুথ বাড়ানো হলেও পরীক্ষার সীমাবদ্ধতায় সব আয়োজনই ব্যর্থ হচ্ছে। নমুনা পরীক্ষার মেশিনের পাশাপাশি লোকবলের ব্যাপক সংকট পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলেছে। ফৌজদারহাটের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজেস (বিআইটিআইডি)- এ দুইটি মেশিন রয়েছে। এখানে সর্বসাকুল্যে লোকবল রয়েছে ৯ জন। এই নয়জনের পক্ষে রাতে দিনে কাজ করে নমুনার পাহাড় সামলানো সম্ভব হচ্ছে না। করোনাকালের আগের নয়জন মানুষ যেসব স্বাভাবিক কার্যক্রম করতেন সেই একই লোকবল দিয়ে করোনার যুদ্ধ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এতে এক শিফটের স্থানে দুই শিফটে কাজ করেও নমুনার জট সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে। বিআইটিআইডিতে দুইটি মেশিনে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুইশ’ নমুনা পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। অথচ এখানে অনেক বেশি নমুনা সামাল দিতে হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে ষোল ঘণ্টা মেশিন চালু রাখতে হচ্ছে।
বিআইটিআইডির ল্যাব প্রধান করোনা জয়ী অধ্যাপক ডাক্তার শাকিল আহমেদ গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমাদের মেশিনের সক্ষমতা হচ্ছে সর্বোচ্চ ২০০ নমুনা পরীক্ষা। অথচ আমরা আড়াইশ’রও বেশি করছি। কিন্তু এতেও সংকটের সুরাহা হচ্ছে না। প্রতিদিন এক হাজারেরও বেশি নমুনা আমাদের কাছে জড়ো হচ্ছে। এতে করে প্রতিদিনই নমুনার পাহাড় তৈরি হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন দেড়শ’ নমুনা চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিভাসু) পাঠাই। সেগুলোকেও আমাদের গুছিয়ে দিতে হয়। পাঁচশ’ নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলোর ডাটা এন্ট্রি করে যথাযথভাবে হিসাব রাখাও কয়েকজনের কাজ।
অথচ এই কাজের জন্য আমাদের কোন লোকই নেই। আমাদেরকে এসব সামাল দিতে হয়। তিনি পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমরা দুরবস্থায় রয়েছি। লোকবল সংকট এবং মেশিনের সক্ষমতা আমাদের হাত পা বেঁধে রেখেছে। আমাদের সদিচ্ছার অভাব না থাকলেও নমুনা পরীক্ষা করে রিপোর্ট প্রদান করতে পারছি না।’
করোনা পরীক্ষায় নমুনা সংগ্রহ থেকে রিপোর্ট দেয়া পর্যন্ত একদিন সময় লাগে বলে উল্লেখ করে ফৌজদারহাটস্থ বিআইটিআইডির ল্যাব প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার শাকিল আহমেদ বলেন, আমরা আগে আড়াইশ’র মতো নমুনা সংগ্রহ করতাম। ওইগুলো আমরা পরীক্ষা করে একদিন পরই রিপোর্ট দিয়ে দিতাম।
কিন্তু বর্তমানে এক হাজারের মতো নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। যেগুলো জট সৃষ্টি করছে।
তিনি বলেন, নমুনা সংগ্রহে কোন নিয়ম কানুন মানা হচ্ছে না। যেভাবে ইচ্ছে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। আগে আমরা উপসর্গ আছে কিংবা রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন এমন নমুনা নিতাম। এখন আর ওসব মানা হচ্ছে না। নানা স্থানে নানাভাবে যার যেভাবে ইচ্ছে নমুনা সংগ্রহ করে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। অনেক দামি কিট নষ্ট করে আমরা নমুনা পরীক্ষা করছি। ফলাফল নেগিটিভ আসছে। কিন্তু এতে যাদের প্রকৃত দরকার তারাই জটে পড়ে যাচ্ছে। যা অনেক বড় সমস্যা সৃষ্টি করছে বলেও অধ্যাপক শাকিল আহমেদ মন্তব্য করেন।
গত ৭ এবং ৮ জুন তিন হাজার নমুনা ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে গতকাল ওই নমুনা থেকে হাজার খানেক নমুনা পরীক্ষা করে পাঠানো হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এবং বিআইটিআইডির এসব নমুনার বাকিগুলো কবে আসবে তা কেউ জানে না।
চট্টগ্রামে নমুুনা পরীক্ষার সুযোগ বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তারা বলেছেন, নমুনা যেভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে তাতে কেইস সিলেকশন ঠিক করতে হবে। উপসর্গ নেই বা রোগীর সংস্পর্শে আসেননি এমন লোকজনের নমুনা সংগ্রহের প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করে তারা বলেন, এতে নমুনার পরিমাণ কমে আসবে। চট্টগ্রামে দৈনিক আটশ’র মতো নমুনা পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জ্বর কাশি কিংবা অন্যান্য উপসর্গ আছে এমন রোগী নিশ্চিত হয়ে নমুনা সংগ্রহ করলে এরকম জট সৃষ্টি হত না। তাহলে আজকের রিপোর্ট কাল দেয়ার সুযোগ তৈরি হতো বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
চট্টগ্রামে করোনা নমুনা পরীক্ষা শুরু হয় বিআইটিআইডিতে। গত ২৬ মার্চ প্রথম নমুনা পরীক্ষা করা হয়। গত ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু) করোনা পরীক্ষা শুরু করে। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও করোনা পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কিন্তু এই চারটি ল্যাবের সক্ষমতা চট্টগ্রামের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি বলে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, এখানের পিসিআর মেশিনগুলো দিয়ে সর্বোচ্চ সাতশ’ পর্যন্ত করোনার নমুনা পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। অথচ দৈনিক এক হাজারেরও বেশি নমুনা সংগ্রহ হওয়ায় জটের সৃষ্টি হয়েছে। নমুনা পরীক্ষার সুযোগ বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করে সূত্র বলেছে, সুযোগ বাড়াতে হবে। সেন্টার বাড়াতে হবে। নমুনা যেভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে সেভাবে যদি সেন্টার বাড়ানো হয় তাহলে আর জট তৈরি হবে না।
বিশেষ করে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে নমুনা পরীক্ষার সুযোগ বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, বেসরকারিভাবে খুব বেশি সুযোগ তৈরি হয়নি। বেসরকারি ইম্পেরিয়াল হাসপাতালই কেবলমাত্র নমুনা পরীক্ষা করতে পারছে। তাও একদিনেই তাদের অন্তত দশ দিনের নমুনা সংগ্রহ করতে হয়েছে। ফলে টাকা দিয়েও নমুনা দেয়ার পর রিপোর্ট মিলছে না চট্টগ্রামের মানুষের। বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার শেভরণকে করোনা পরীক্ষার অনুমোদন দেয়া হলেও তারা কাজ শুরু করতে পারেনি। ইতোমধ্যে কয়েকদফা সময় দিয়েও নানা সীমাবদ্ধতায় তারা করোনা পরীক্ষা করতে পারছে না।
চট্টগ্রামের করোনা নমুনা পরীক্ষার পুরোধা চিকিৎসক, বিআইটিআইডির ল্যাব প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার শাকিল আহমেদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, পরীক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে। লোকবল বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে আমি প্রশিক্ষণ দেব। সুযোগ না বাড়ালে চট্টগ্রামে আগামী দিনগুলো খুবই খারাপ হবে বলেও তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।
চট্টগ্রামে দুইটি হাসপাতাল নমুনা পরীক্ষা করছে বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, বাকি দুইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নমুনা পরীক্ষা তাদের কাজ নয়। চট্টগ্রামের সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে নমুনা পরীক্ষার নেটওয়ার্কে নিয়ে আসারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতাল, সিএসসিআর, ম্যাঙ, পপুলার এবং এপিকের মতো প্রতিষ্ঠানে নমুনা পরীক্ষা করানো গেলে মানুষের ভোগান্তি কমে আসতো বলেও সূত্র মন্তব্য করেছে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডাক্তার সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, করোনা নমুনা পরীক্ষার সুযোগ বাড়াতে বুথ বাড়ানো হয়েছে। এখন আগের চেয়ে অনেক কম ভোগান্তিতে মানুষ নমুনা দিতে পারছে। অন্যান্য সীমাবদ্ধতা কাটানোর জন্য সরকার কাজ করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এটি একটি নতুন সমস্যা। একেবারে নতুন। আমাদেরকে বিষয়টি সামাল দেয়ার জন্য কিছু বাড়তি মনযোগ এবং সময় দিতে হচ্ছে। অচিরেই সব ঠিক হয়ে যাবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
Discussion about this post