আতাউর রহমান
পুলিশ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। অপরাধ বিশেষজ্ঞ; চিকিৎসা বিজ্ঞান তার জানার বাইরে। সেই কর্মকর্তাই এখন করোনাভাইরাস থেকে মানুষ বাঁচাতে নিরন্তর দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছেন, করোনা আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীর প্লাজমা থেরাপি নিয়ে রীতিমতো সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। ডোনার খোঁজেন, হাসপাতালের মাধ্যমে প্লাজমা সংগ্রহ করেন, মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে চিকিৎসকের মাধ্যমে তা প্রয়োগ করান। গত এপ্রিল মাসের শুরু থেকে এমন মহৎ কাজ করে যাচ্ছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
নিজেই জানালেন, এ পর্যন্ত ২২ জনকে প্লাজমা সংগ্রহ করে দিতে পেরেছেন তিনি। তার আগ্রহ আর উদ্যোগে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চিকিৎসকদের পরামর্শে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালেও শুরু করেছেন প্লাজমা থেরাপি। এখন প্লাজমার ডোনার আর গ্রহীতা রোগীর মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে দিতে চালু করতে যাচ্ছেন বিশেষ সেল।
রফিকুল ইসলাম বর্তমানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। সংঘটিত অপরাধের রহস্য ভেদ করে অপরাধী শনাক্ত আর গ্রেপ্তার করা তার কাজ। এর আগে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি) দায়িত্ব পালন করার সময়েও বহু ক্লুলেস মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন, গ্রেপ্তার করেছেন দুর্ধর্ষ আসামি। দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রেষণে দায়িত্ব পালন করতে গিয়েও আতঙ্ক ছড়িয়েছেন দুর্নীতিবাজদের মনে।
পুলিশ বিভাগের সেই কর্মকর্তা স্বাস্থ্য বিভাগের বিষয়ে কেন মানুষকে সচেতন করতে মাঠে নামলেন? সমকালকে সেই প্রশ্নের উত্তরে রফিকুল ইসলাম বলছিলেন, দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের পর তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। ওষুধ নেই, ভ্যাকসিন নেই, নিজে আক্রান্ত হলে রক্ষা পাবেন কীভাবে- তা ভাবতে থাকেন। এরপর ইন্টারনেট ঘেঁটে চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো জানার চেষ্টা করেন। এর মধ্যেই তার নজরে আসে প্লাজমা থেরাপির বিষয়টি। এ বিষয়ে চিকিৎসা সাময়িকীগুলো থেকে নানা গবেষণাপত্র অধ্যয়ন শুরু করেন। ভার্চুয়ালি খোঁজ নিতে থাকেন উন্নত দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও।
তিনি বলেন, নানা পেপার ঘেঁটে বুঝতে পারি, দুনিয়াতে অ্যান্টিবায়োটিক আবিস্কারের আগে ১০০ থেকে ১২৫ বছর ধরে মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে প্রায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন প্লাজমা থেরাপি চলে আসছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এই থেরাপি এখন আরও আধুনিক হয়েছে। কম খরচে ও কম সময়ে তা সংগ্রহ করে রোগীর দেহে প্রয়োগ করা যায়। অর্থাৎ রোগ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তির দেহের রক্ত থেকে প্লাজমা (রক্তরস বা উপাদান) মাত্র আধা ঘণ্টায় সংগ্রহ করা যায়।
পুলিশ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানালেন, এপ্রিলের শুরুর দিকে তিনি বিষয়টি নিয়ে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান এবং কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের প্রধানকে ব্রিফ করেন। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজির সঙ্গে আলাপ করেন করোনা রোগীদের এই থেরাপি প্রয়োগের বিষয়ে। নিজে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশিষ্ট চিকিৎসক এম এ খানসহ পরিচিত চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপ করতে থাকলেন।
তিনি বলেন, একপর্যায়ে বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা রোগীদের প্লাজমা থেরাপি দেওয়া শুরু হলো ও কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে প্লাজমা সংগ্রহের মেশিনও স্থাপন করা হলো। তবে এসব করা হচ্ছে হাসপাতালগুলোর ইথিকস কমিটির সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। জাতীয় পর্যায়ে করোনা রোগীদের জন্য প্লাজমা থেরাপি কার্যক্রম শুরু হয়নি এখনও।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি নতুন হওয়ায় তার এই সচেতনতা কার্যক্রমের শুরুর দিকে অনেক বাধা পেরোতে হয়েছে তাকে। এখন এই থেরাপি নিয়ে চিকিৎসক, সেরে ওঠা রোগী আর আক্রান্ত রোগীর স্বজনরা সচেতন হয়েছেন। অনেকে প্লাজমা দিতে চাচ্ছেন, অনেক রোগীর স্বজনরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু জাতীয় বা সমন্বিত কার্যক্রম না থাকায় তারা জানেন না কোথায় তা দেবেন, কোথা থেকে নেবেন।
তিনি বলেন, নিজের পেশাগত দায়িত্ব পালনের বাইরে তাকে এই সচেতনতার কাজ, ডোনার সংগ্রহ থেকে শুরু করে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হচ্ছে। তার কাজ হচ্ছে- দুই পক্ষের মধ্যে শুধু সমন্বয় করিয়ে দেওয়া। এসব কাজে পুরোটা সময় করে উঠতে পারছেন না। তাই চিন্তা করছেন নিজের বেতনের টাকার অংশ থেকে একটি সেল তৈরি করবেন। সেখানে এমন একজনকে নিয়োগ দেবেন, যিনি ২৪ ঘণ্টা ডোনার এবং রোগী পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেবেন। এ ছাড়া মোবাইল ফোনসহ নানা মাধ্যমে প্লাজমা থেরাপি বিষয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলে তথ্য সরবরাহ করবেন।
Discussion about this post