করোনা সংশ্লিষ্ট বিপজ্জনক উপসর্গে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার খবরে আতংকে আছেন অভিভাবকরা। এ পর্যন্ত ছয় শতাধিক শিশুর শরীরে মিলেছে কভিড-১৯ এর অস্তিত্ব।
তবে চট্টগ্রামে এখনও পর্যন্ত পেডিয়াট্রিক মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিনড্রোম (পিএমআইএস) রোগে কারও আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, দুইমাস আগে রোগটি প্রথম শনাক্ত হয় যুক্তরাজ্যে। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতে এ রোগ দেখা দেয় শিশুর শরীরে। বাংলাদেশে পিএমআইএস প্রথম শনাক্ত হয় গত ১৫ মে।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত বয়সীরা মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিনড্রোম (এমআইএসসি) বা পেডিয়াট্রিক মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিনড্রোম (পিএমআইএস) নামের নতুন ও বিরল এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
লক্ষণ হিসেবে শরীরে ৩-৫ দিনের বেশি স্থায়ী জ্বর, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া ও বমি ভাব, চোখ, ঠোঁট ও জিহ্বা লাল হয়ে যাওয়া, চামড়ায় ফুসকুড়ি, ত্বকের নিচে রক্ত জমতে পারে, বুকে ব্যথা অনুভব হবে, শ্বাসকষ্ট ও ক্লান্তি লাগবে এবং খাওয়ার ব্যাপারে অনীহা দেখা দেবে।
ঢাকার বেসরকারি এভার কেয়ার হসপিটালে গত ২৭ মে পিএমআইএস আক্রান্ত রোগী সাড়ে ৩ মাস বয়সী এক মেয়ে ও ২ বছর ২ মাস বয়সী এক ছেলে শিশুর চিকিৎসা সফলভাবে সম্পন্ন হয়। আরটি-পিসিআর টেস্টে ছেলে শিশুটির কোভিড-১৯ পজিটিভ আসে।
দুই শিশুকেই গভীর পর্যবেক্ষণে রেখে ইন্ট্রাভেনাস ইমিউনোগ্লোবুলিন (আইভিআইজি) দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।
ফৌজদারহাটের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজ (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে গত ২১ এপ্রিল কোভিড-১৯ রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষায় ১০ মাস বয়সী এক শিশুর শরীরে করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়।
শাহরিয়ার আলম আবির নামের শিশুটি চন্দনাইশ উপজেলার পূর্ব জোয়ারা গ্রামের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ওমান প্রবাসী মাহবুবুল আলমের ছেলে।
শিশুর মা রুমা আক্তার জানান, কোনও আত্মীয়ের বাসায় যাইনি, কেউ বাসায়ও আসেনি। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাচ্চা করোনা আক্রান্ত হয় বলে ধারণা করছি। বাচ্চার শ্বাসকষ্ট ছিল। পর পর দু’বার পরীক্ষায় করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট আসায় ২ মে বাসায় যাওয়ার অনুমতি দেন চিকিৎসকরা।
সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী বাংলানিউজকে বলেন, চিকিৎসকদের আন্তরিক চেষ্টায় ওই শিশুটি করোনা ভাইরাসকে পরাজিত করেছে। বাংলাদেশ এত কম বয়সী কোনও শিশু করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে কি না আমার জানা নেই। আবির আমার কাছে সর্বকনিষ্ঠ রোগী।
এদিকে গত ১২ এপ্রিল চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত হয়ে ছয় বছর বয়সী আশরাফুলের মৃত্যু হয়। ওই শিশু পটিয়ার হাইদগাঁও ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড ওসমান পাড়ার খলিলুর রহমানের ছেলে। আশরাফুলের চাচা মফিজুর রহমান হংকং থেকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। তার মাধ্যমে শিশুটি সংক্রমিত হতে পারে ধারণা করছে পরিবার।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শিশু আবির ও আশরাফুলের উপসর্গ ছিল শ্বাসকষ্ট। এছাড়া পিএমআইএস এর কোনও লক্ষণ ছিল না। করোনারি রক্তনালী ফুলে যাওয়া, খিচুনি, হার্ট বড় হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গও ছিল না তাদের।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সী ও ১০ বছরের ঊর্ধ্বে দুই ক্যাটাগরিতে ৮ শতাংশ শিশু করোনা আক্রান্ত। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে এবং অনেকে সুস্থও হচ্ছে। এসব শিশুর শরীরে জ্বর-কাশি কিংবা শ্বাসকষ্ট ছাড়া পিএমআইএস এর লক্ষণ মিলেনি এখনও পর্যন্ত।
তবে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ ও এমআইএসসি বা পিএমআইএস একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক রয়েছে। পজিটিভ অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে প্রমাণিত হয়েছে, পিএমআইএস-এ আক্রান্ত শিশু পূর্বে করোনা আক্রান্ত হয়েছিল, অনেক ক্ষেত্রে তাদের কোনও লক্ষণও ছিল না।
এরপরও শিশুদের মধ্যে এই ভাইরাসটি সক্রিয় থাকতে পারে এবং একইসঙ্গে তার শরীরে পিএমআইএস এর লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
বাংলাদেশে প্রথম পিএমআইএস শনাক্তকারী দলের সদস্য শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. তাহেরা নাজরিন জানান, পিএমআইএস রোগীর দেহে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের উপস্থিতি বা কোভিড-১৯ ডায়াগনসিস করার জন্য কোনও উপসর্গ থাকতেই হবে, তা জরুরি নয়। চিকিৎসার জন্য নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন হয়, এমনকি আইসিইউ’রও প্রয়োজন হতে পারে।
তিনি জানান, পিএমআইএস রোগে খুব দ্রুত গতিতে শরীরের একাধিক অঙ্গে রক্তনালীর প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এতে রক্তের প্রবাহ কমে গিয়ে হার্ট, কিডনি, ফুসফুস ও যকৃতের মতো একাধিক অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই রোগের বৈশিষ্ট্য অনেকটা কাওয়াসাকি ডিজিজ ও টক্সিক শক সিনড্রোমের মতো।
বাংলাদেশ পেডিয়েট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) এর সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রামে এখনও পিএমআইএস রোগী পাওয়া যায়নি। তাই অভিভাবকদের আতংকিত হওয়ার কিছু নেই।
তিনি বলেন, ঢাকায় যে দু’জন শিশু আক্রান্ত হয়েছিল, তারাও সুস্থ হয়েছে। তবে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তাদের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজন। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। কিছুক্ষণ পরপর হাত ধোয়া ও ২ বছরের বেশি বয়সের শিশুর মুখে কাপড়ের মাস্ক পরানো যেতে পারে।
‘এই সময়ে শিশুদের পিএমআইএস হওয়া থেকে বাঁচানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, তাদের কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা। যা নিশ্চিত করতে পারেন অভিভাবকরাই’ বলেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। -বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
Discussion about this post