- নাদিম মাহমুদ
- লকডাউন ছেড়ে করোনাভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করছে মানুষ। বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশগুলোতে ধীরে ধীরে কাজে ফিরেছে মানুষ। তবে পুরাতন চেহারায় না গিয়ে করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি নির্ভর জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে অনেকে। মৃত্যুর আলিঙ্গন কাঁধে নিয়ে বাংলাদেশও শরিক হয়েছে অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে। জীবন বাঁচানোর এই যুদ্ধ আমাদের প্রজন্ম কিংবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মর কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। এর মধ্যে বড় ধাক্কাটি লেগেছে আমাদের শিক্ষায়।
ইউনিসেফের তথ্যমতে কোভিড আক্রান্ত ১৩৪টি দেশের মধ্যে ১০৫টি দেশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা চিন্তা করছে। অগাস্টে এই ১০৫টি দেশের মধ্যে ৫৯টি দেশের স্কুল খুলে দেয়া হয়েছে বলে সংস্থাটি জানাচ্ছে (সূত্র-১)। এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন জানতে পারলাম, ভারত ও পাকিস্তান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দিয়েছে। তারা ধাপে ধাপে চলতি মাসেই ক্লাসে ফেরাতে চান শিক্ষার্থীদের। (সূত্র-২)
বাংলাদেশেও প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্দেশনা মেনে খোলার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিদ্যালয় পুনরায় চালুর নির্দেশনা মানতে স্কুলগুলোতে পোস্টার ও লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করার মত এসেছে মন্ত্রণালয় থেকে (সূত্র-৩)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও করোনাকালীন শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে কিছু আলোকপাতও করেছে তারা (সূত্র-৪)।
মার্চের পর কার্যত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে সারাবিশ্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অচিল হয়ে গিয়েছে। সমাধানের চেষ্টায় শিক্ষাবিদরা থাকলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি না। করোনাকালীন শিক্ষার এই বেহাল অবস্থা দেখে শিক্ষক, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অভিভাবকরাও চিন্তিত। এরই মধ্যে বেশকিছু স্তরের পাবলিক পরীক্ষা চলতি বছরে স্থগিত করা হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা। নিয়মাফিক তাদের এইচএসসি পরীক্ষা এপ্রিলে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়তে থাকায় গত ছয় মাসেও তারা পরীক্ষায় বসতে পারেনি। এর মধ্যে পরীক্ষা নেয়া হবে না মর্মে বেশ কিছু গুজবের ডালপালা ছড়িয়েছিল, তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বারবার বিবৃতি দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। তবে কবে এই পরীক্ষা নেয়া হবে বা আদৌও হবে কি না, পরীক্ষা না হলে কিভাবে মেধার মূল্যায়ন করা হবে তার যৌক্তিকতা খুঁজতে সম্ভবত শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।
ওদিকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শ্রেণিগুলোর সামনে বার্ষিক পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও সে বিষয়টিও থমকে আছে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা নিয়ে অভিভাবকরা হতাশ হলেও আপাতত কোনো দিকনির্দেশনা পাচ্ছে না। উন্মুখ হয়ে বসে আছে শিক্ষকরা, কবে তারা ক্লাসে ফিরবে, প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে বিদ্যালয়ের আঙিনা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের পদচারণা নেই গত কয়েক মাস ধরে। ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট আর পরীক্ষা থেকে বিরত থাকা শিক্ষার্থীরা সম্ভবত জীবনের দীর্ঘ ছুটি ভোগ করছে। গত কয়েক দশক ধরে সেশনজটের খপ্পর থেকে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বের হওয়ার চেষ্টা করছিল, সেই প্রচেষ্ঠায় কিছুটা ভাটা টেনেছে কোভিড-১৯।
শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে নিজের বাড়িতে। শিক্ষাবর্ষের শেষ দিকে এসে আটকা পড়া লাখো শিক্ষার্থীর কর্মজীবনে প্রবেশের কথা থাকলেও গত ছয় মাস তাদের আশায় বাজ পড়েছে। সহসা সমাধানও নেই তাদের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষকরা গবেষণায় জড়িত ছিল, শিক্ষার্থীদের পদচারণার অভাবে সেইগুলোও ভেস্তে যেতে বসছে। অতল এই পরিস্থিতিতে সমাধান কি হতে পারে, তা নিয়ে কথা বলার সময় বুঝি আমাদের চলে এসেছে।
বিশ্বের অন্যন্য দেশ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থবিধি মেনে চলার প্রেক্ষিতে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সচল করলেও আমাদের দেশের মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের কারণে সংক্রমণ ও মরণের সংখ্যার স্থিতিশীলতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। নিরাপদ স্বাস্থ্যবিধি আমরা যদি না মানতে পারি আর ভ্যাকসিনের দেখা যদি আমরা না পাই তাহলে আমাদের দেশে মাসের পর মাস সংক্রমণ চলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মূলত অবহেলার কারণে, আমাদের দেশে সংক্রমণের পারদ চড়ছে। স্কুল খুলে দেয়ার আগে যেসব বিষয় আমাদের অবশ্য করণীয় তা নির্ধারণ করতে হবে। যেমন-
১. জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার স্কুলে যেসব নিয়ম মেনে ক্লাস শুরু হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো, শিক্ষার্থীদের প্রথমে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয় বাসায় আর দ্বিতীয়বার স্কুলের প্রবেশদ্বারে। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য আলাদা আলাদা স্থান রয়েছে। অনেক স্কুলের ক্যান্টিনে প্লাস্টিকের পর্দা মুখোমুখি ব্যবহার করা হয় যা তাদের বন্ধুদের থেকে আলাদা করে। মাস্ক পরে স্কুলে আসে আর ক্লাস কিংবা খেলার মাঠে সামাজিক দূরত্ব সঠিকভাবে মেনে চলে। (সূত্র-৫)
২. যেসব যানবাহনে তাদের স্কুলে আনা নেয়া করা হচ্ছে, সেইসব যানবাহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আসন ফাঁকা রাখা হচ্ছে। শারীরিক স্পর্শ যেন না হয়, সেইজন্য তাদের পরিবার থেকে বারবার সচেতন করা হয়।
৩. স্কুল খুলে দেয়ার আগে বিদ্যালয়গুলোতে স্ক্যানিং টেমপারাচার মিটার সরবরাহ করা বাঞ্ছণীয়।
৪. স্কুলে বাচ্চারা সাধারণত খেলাধুলা করতে পছন্দ করে। তাই তারা যখন খেলাধুলা করবে, মাঠে চক দিয়ে বৃত্ত করে দিতে হবে, তাদেরকে বুঝাতে হবে যেন এই বৃত্তের বাহিরে খেলাধুরা না করে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার জন্য এই নিয়ম অনেক দেশেই কার্যকরী হয়ে উঠছে (সূত্র-৬)
৫. যেহেতু শিশুরা স্বাস্থ্যবিধি জানে না, তাই দেশের প্রচারমাধ্যমগুলোতে কিভাবে স্কুলে স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে তার বিস্তারিত জানাতে হবে। শুধু সরকার এই কাজটি করলেই হবে না, বাসায় অভিভাবকদের তাদের শিশুরা এইসব স্বাস্থ্যবিধি বুঝছে কি না তার জন্য ট্রায়াল নিতে পারে। আর এজন্য অন্তত কিছু সময় দেয়া প্রয়োজন। শুধু পোস্টার আর লিফলেট বিলি করলে হবে না, শিশুদের বুঝাতে, করোনাভাইরাস সম্পকে ধারণা দিতে হবে।
৬. আমাদের মনে রাখতে হবে, বড়রা স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস-আদালত করলেও স্কুলগামী শিশুদের দ্বারা পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে। তাই শিশুরা স্কুল থেকে ফিরলে, তার সংস্পশে আসার আগে স্যানিটাইজার ও পোশাক পরিবর্তনে সহায়তা করতে হবে।
৭. স্কুল খুলে দেয়ার আগে আমাদের উচিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়া। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে তারা ক্লাসে ফিরবে। তাদের অবস্থা দেখে পর্যায়ক্রমে কলেজ, স্কুল ও প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দেয়া যেতে পারে। এই ক্রম অনুসরণ করলে, আমরা অন্তত শিশুদের সচেতনতার পাশাপাশি তাদেরকে কোভিড-১৯ ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝিয়ে তুলতে সক্ষম হবো।
৮. বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার একটি বড় বাধা হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমে শিক্ষার্থীরা গাদাগাদি করে থাকে। তাই এইসব কক্ষে যারা থাকত, তাদের জন্য বিকল্প আবাসন ব্যবস্থা করতে হবে। ক্যান্টিনে খাওয়ার সময় হলগুলোর ব্লকভিত্তিক পরিবেশন করা যেতে পারে। ফলে এক সাথে ক্যান্টিনে খাওয়ার ভিড় কমবে। অন্যদিকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার অভ্যাসও গড়ে উঠবে।
৯. আমরা যদি স্কুল খোলার চিন্তা করি, তাহলে পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান খুলতে হবে। গ্রামে, মফস্বলে কিংবা শহরের স্কুলের স্বাস্থ্যবিধি তৈরি করে তা মেনে একটা মডেল দাঁড় করানো যেতে পারে। পরীক্ষামূলক ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে অন্যন্য প্রতিষ্ঠান খোলা যেতে পারে।
১০. শহরে যখন স্কুল শুরু হয়, ঠিক একই সময় অফিস আদালত শুরু হয়। ফলে রাস্তায় যানবাহনে শারীরিক সংস্পর্শ আসার সম্ভবনা তৈরি হয়। তাই অফিস আদালতের আর স্কুলের সময় ভিন্ন হওয়া জরুরি।
১১. যেসব শিক্ষার্থী ও শিক্ষক কিংবা স্টাফদের করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা যাবে, সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে আইসোলেশনে পাঠাতে হবে। তাদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে।
উন্নত দেশগুলো অনলাইন ও টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রেখেছে। খোদ চীন তাদের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন, রেডিও ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেছে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর মে মাস থেকেই তাদের শিক্ষার কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেমিনার সিম্পোজিয়ামও জুম অ্যাপসে হয়েছে। এমনকি মাস্টার্স, পিএইচডির চূড়ান্ত প্রেজেন্টেশনও সম্পন্ন হয়েছে (সূত্র-৭)।
এখন আসা যাক, কিভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদান, পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। করোনাকালীন শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে, তার একটি প্রস্তাবনা তুলে ধরতে চাই।
মাধ্যমিক ও প্রাথমিক
মাধ্যমিক ও প্রাথমিকে ক্লাস শুরু করা যেতে পারে কিছু নিয়ম মেনে। ধরুন একটি বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৫০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে দেশে সাধারণত প্রতিদিন একটি বিদ্যালয়ে সব শ্রেণির ক্লাস হতো। তবে আমি যে প্রস্তাবনা দিচ্ছি, সেখানে প্রতিদিন একটি করে শ্রেণি স্কুলে আসবে। সামাজিক দূরত্ব সঠিকভাবে মেনে ক্লাস নিতে হলে এই নিয়ম মানা জরুরি। প্রতিদিন একটি করে শ্রেণি ক্লাসে অংশ নিতে পারলে সপ্তাহের পাঁচদিন পাঁচটি শ্রেণির ক্লাস নেয়া সম্ভব।
আগে একটি কক্ষে যেখানে পঞ্চাশজন শিক্ষার্থী বসতে পারত, নতুন নিয়মে সেখানে বসবে ১৫-২০ জন করে। যে শিক্ষক প্রতিদিন তিনটি বা চারটি করে ক্লাস নিত, সেই শিক্ষক কেবল একটি শ্রেণিতে তিনটি ক্লাস নেবেন। ধরুন, ৫০ জন শিক্ষার্থীকে আমরা যদি তিনটি গ্রুপে ভাগ করি, তাহলে ১৬-১৭ জন করে গ্রুপ ক্লাস করবে। গ্রুপ-এ ইংরেজি ক্লাসে, গ্রুপ-বি গণিত ক্লাসে, গ্রুপ-সি বাংলা ক্লাস করবে একই সময়ে। এক গ্রুপের ক্লাস শেষ হলে অন্য গ্রুপের ক্লাস যোগ দেবে। এইভাবে পরবর্তী ঘণ্টায় ফের নতুন করে আরো একটি বিষয়ে ক্লাস শুরু হবে একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে।
এইভাবে ক্লাস শুরু হলে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছুটা হলেও উৎকণ্ঠা কমবে। অন্যদিকে ক্লাসে প্রচলিত সিলেবাসকে সংস্করণ করে গুরুত্বপূর্ণ সিলেবাসে ক্লাস করানো উচিত। যাতে করে গত ছয় মাসের ক্লাসের ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারে।
বাষিক পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বিকল্প কোনো পথ খুঁজতে হবে। বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীর পরীক্ষা যদি নেয়াও হয়, তবে তা হবে অতি সংক্ষিপ্তকারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার চেয়ে সঠিক শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা হল মূখ্য কাজ।
উচ্চ মাধ্যমিক
উচ্চ মাধ্যমিকে ইতোমধ্যে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই ভর্তি প্রক্রিয়ার পর ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষা থমকে থাকায় উচ্চ মাধ্যমিকে তিনটি ব্যাচ কলেজগুলোতে থাকছে। ক্লাস ও এইচএসসি পরীক্ষা একই সাথে চালু হলে করোনাকালীন বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। তাই সবার আগে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। আমার বিশ্বাস, নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ স্মার্টফোন ব্যবহার করছে। তাই এদের ক্লাসগুলো অনলাইনে সচল রাখা যেতে পারে। ক্লাসের পর শিক্ষকদের প্রেজেন্টেশন ফাইল ওয়েবসাইটে আপলোড দেয়া যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দেয়া যেতে পারে। ফলে যেসব শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস মিস করবে কিংবা যাদের স্মার্টফোন নেই, তারা এইসব শিক্ষা সামগ্রী জেরোক্স করতে পারে। বাসায় পড়াশুনা করবে, অ্যাসাইনমেন্ট ই-মেইলে জমা দেয়া যেতে পারে।
এইচএসসি পরীক্ষা
উচ্চ মাধ্যমিকের মূল্যায়ন খুব জরুরি। তাই পরীক্ষা ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সমাধান পাওয়া কঠিন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দীক্ষা তাই সবার আগে প্রয়োজন। তবে পরীক্ষা কিভাবে নেয়া হবে আর কত সময়ের মধ্যে মূল্যায়ন করা হবে সেটিরও কোনো দিকনির্দেশনা আপাতত আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছি না। করোনাভাইরাসের এই সংকটময় সময়ে নিয়মতান্ত্রিক পরীক্ষা পদ্ধতির কিছুটা পরিবর্তন আনা জরুরি। এই পরিবর্তন না আনলে আমরা এইচএসসি পরীক্ষার জট খুলতে পারব কি না সন্দেহ রয়েছে।
পরীক্ষার প্রশ্নের কাঠামোর সংস্করণ করা যেতে পারে। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা গ্রহণ করতে হলে পরীক্ষা কেন্দ্র আগের তুলনায় দ্বিগুণ করতে হবে। সেটি করতে না পারলে দুই শিফটে সকাল-বিকেল পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বাংলা, ইংরেজি প্রথমপত্র ও দ্বিতীয়পত্রের সম্বলিত প্রশ্নপত্রে একটি করে মানে বাংলা ও ইংরেজি পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের তিন ঘণ্টার পরীক্ষা করা যেতে পারে ১ ঘণ্টায়। পরীক্ষা লিখিত না এমসিকিউ হবে সেটার জন্য আলোচনা করা যেতে পারে। আমরা যদি লিখিত পরীক্ষার পরবর্তীতে এমসিকিউ করি তাহলে, বিভিন্ন সেটে একই দিনে একই বিষয়ে পালাক্রমে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব মানতে সুবিধা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের পরই সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আর ভর্তি পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীর যে প্রস্তুতি নিতে হয়, তা এই কম সময়ে সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না। তাই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কিছু নতুনত্ব আনা প্রয়োজন। গত বছর বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সেখান থেকে খসে পড়লেও এবার করোনাকালীন সময়ে আমরা মনে করি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা সবচেয়ে কাজে দেবে। শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষার জন্য এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ছোটাছুটি বন্ধ করতে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আমাদের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় আসতে হবে।
আর ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বছরে দুই সেশনে নেয়া যায় কিনা তা ভাবতে হবে। বিশ্বের সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্প্রিং ও অটাম সেশন চালু রয়েছে। ফলে এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বছরে দুইবার ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পায়।
এইচএসসি পরীক্ষা যদি নভেম্বরে শুরু করা যায় তাহলে তাদের ফলাফল পেতে জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি লেগে যেতে পারে। অন্যদিকে পরের ব্যাচের এইচএসসি পরীক্ষাও এপ্রিল/মে মাসে শুরু হবে। ফলে এই দুই সেশনের ভর্তি নিয়ে সংশয় তৈরি হতে পারে। আর যে কারণে অন্তত আগামী বছর দুয়েক আমরা করোনাভাইরাসের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত রাখতে দুই শিফট চালু করতে পারি। আর সেটি করতে পারলে গত ছয় মাসের ক্ষতি কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে পারব।
বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আলোচনায় আসা উচিত যে, তারা কিভাবে অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার শেষ করবেন। ক্রেডিট ও সিজিপিএ ব্যবস্থায় পরীক্ষার মানবণ্টন নির্ভর করায় এখানে বিষয় সংকোচন করা সমচীন হবে না বৈকি। একটি বিভাগে ক্লাসের পাশাপাশি বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষাও লেগে থাকে। তাই ছয় মাসের ঘাটতি পূরণ করতে সিলেবাসে কিছুটা সংস্কার করা যেতে পারে। সংস্কার করা চ্যাপ্টারগুলো পরবর্তী বর্ষে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। আমরা যেহেতু জানি না, কোভিড-১৯ কবে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেবে সেহেতু এটাকে মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক সিলেবাস করতে হবে। আমরা যদি ডাবল শিফট চালু করতে পারতাম, তাহলে হয়তো এই লম্বা বিরতির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব। যদিও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাবল-শিফটের সুযোগ সুবিধা নেয়। শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ সংকটে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাবল শিফট চালু করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। কোভিড-১৯ যদি সত্যি আগামী বছর থাকে, তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে ডাবল শিফট চালু করা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উপায়ন্তর দেখছি না।
নিয়মের ভেতর থেকে উন্নত দেশগুলো তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা বড়ই চ্যালেঞ্জিং। আর এই চ্যালেঞ্জকে বাস্তবতায় নিয়ে যেতে হলে অবশ্যই আমাদের সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে সমাধান করতে হবে। মনে রাখতে হবে শিশুরা আক্রান্ত হলে আপনি আমি যতই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, তা কোনো কাজে আসবে না। তাই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার আগে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কীভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামনে এগিয়ে নেব। কীভাবে, আমরা কোভিড-১৯ মোকাবেলা করে শিক্ষাকে এগিয়ে নেব। কেবল খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়ে সব দায়িত্ব শেষ এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। আমরা চাইব, আগামী দিনের প্রজন্ম শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শিক্ষাটুকু আত্মস্থ করবে। আমরা এগিয়ে যাব।
তথ্যকণিকা
১. https://www.unicef.org/coronavirus/what-will-return-school-during-covid-19-pandemic-look
২. https://bangla.bdnews24.com/neighbour/article1799418.bdnews
৩. https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1799240.bdnews
জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত
Discussion about this post