নিউজ ডেস্ক
দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) স্থাপন করা হচ্ছে অত্যাধুনিক ডিজিটাল ল্যাবরেটরি (ল্যাব)। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করে হুন্ডি, মানি লন্ডারিং ও অবৈধ অর্থ লেনদেনসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা হবে।
আরও জানা গেছে, ল্যাব স্থাপনে ডেটা সেন্টারের জন্য ২০০০ বর্গফুটের একটি বিশেষ নিরাপদ কক্ষ বরাদ্দসহ অবকাঠামোগত কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। উন্নত দেশ থেকে, বিশেষ করে ইউএসএ, ইউকে, সিঙ্গাপুর, সুইডেন ও কানাডা থেকে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিও আনা হয়েছে। ফরেনসিক পরীক্ষার বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আগামী সপ্তাহে দুদকের তথ্য-প্রযুক্তি ও সাইবার ইউনিটপ্রধান রাজিব হাসানের নেতৃত্বে একটি টিম আমেরিকায় যাচ্ছে। চলতি মাসের শেষে ফরেনসিক ল্যাবের কার্যক্রম শুরু করা হতে পারে। প্রথম ধাপে ল্যাব স্থাপনে ব্যয় হচ্ছে ৮ কোটি টাকা। টেন্ডারের মাধ্যমে ল্যাব স্থাপনের কাজটি করে ‘ডায়নামিক সলুশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, দেশে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে। অবৈধ অর্থ নানা কায়দায় স্থানান্তর করা হচ্ছে। এসব কাজে নানা ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করা হয়। দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তকালে আসামি বা সন্দেহভাজন যে কারও ডিভাইস জব্দ করে পরীক্ষা করে অভিযোগের সত্যতা পেলে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সূত্র জানায়, ড্রোনেরও ফরেনসিক পরীক্ষা করতে পারবে দুদক। এর মধ্যদিয়ে ড্রোনের মধ্যে ক্ষতিকর কিছু আছে কি না, তা জানা যাবে।
জানা গেছে, ল্যাব স্থাপনের পরপরই অন্তত এক ডজন আসামির বিষয়ে লেনদেন ও মেইল চালাচালির বিষয়ে ফরেনসিক পরীক্ষা করা হবে। দুদক ফরেনসিক ল্যাবে নিম্নলিখিত যেসব ডিজিটাল যন্ত্রপাতি রয়েছে তা হল: কম্পিউটার ফরেনসিক, মোবাইল ফরেনসিক, অডিও ফরেনসিক ও ভিডিও ফরেনসিক।
কম্পিউটার ফরেনসিকের মাধ্যমে কম্পিউটার ও ডিজিটাল স্টোরেজ মিডিয়া থেকে গোপনীয় ডেটা উদ্ধার ও বিশ্লেষণ করা হবে। থাম্ব ড্রাইভ, ইন্টারনেট, ল্যাপটপ এবং অন্য পদ্ধতিগুলোর মতো বৈদ্যুতিক ডিভাইস দিয়ে তথ্য এবং অন্যান্য মূল্যবান ডেটা সংরক্ষণ বা স্থানান্তর করা হবে। অপরাধ ঢাকতে বা আলামত গায়েব করতে মুছে ফেলা তথ্য, সোআপ ফাইল, মেমরি ডাম্প, হার্ড ড্রাইভে ফাঁকা ফোল্ডার, প্রিন্ট স্পুলার ফাইল এবং অস্থায়ী ক্যাশের মধ্যে স্ল্যাক স্পেস-এর ফরেনসিক পরীক্ষা করবে দুদক।
মোবাইল ফরেনসিকের মধ্যে রয়েছে অপরাধ কাজে ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও যে কোনো ডিভাইস। ফরেনসিকের মাধ্যমে মোবাইল ফোন, ট্যাব, জিপিএস, ডিভাইস, ড্রোন ইত্যাদি থেকে ডেটা উদ্ধার ও বিশ্লেষণ করা হবে। দুদকের টিম যেসব ডেটা উদ্ধার ও বিশ্লেষণ করবে তার মধ্যে রয়েছে-এসএমএস এবং এমএমএস বা এ-জাতীয় মুছে ফেলা ডেটা, কল লগ ও যোগাযোগের তালিকা, ফোন আইএমইআই ও ইএসএন সম্পর্কিত তথ্য, ওয়েব ব্রাউজিং, ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সেটিংস, জিওলোকেশন তথ্য, ই-মেইল এবং ইন্টারনেট মিডিয়া ও ফর্ম, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং পরিষেবা, পোস্ট বা এ-জাতীয় ডেটা। অ্যাপ ডেটা, মেসেঞ্জার ডেটা ও ক্লাউড ড্রাইভে সংরক্ষিত ডেটা।
এ ছাড়া অডিও ফরেনসিকের মধ্যে রয়েছে-ভয়েস বা অডিও ক্লিপ প্রমাণের সত্যতা প্রতিষ্ঠা করতে ফরেনসিক পরীক্ষা, কথোপকথন শনাক্তকরণ, সংলাপ লিপিবদ্ধকরণ। ভিডিও ফরেনসিকের মধ্যে ডিজিটাল (ডিভিআর ইত্যাদি) এবং অ্যানালগ ভিডিও প্রসেসিং, ডেমাল্টিপ্লেক্স ভিডিও, ভিডিও থেকে স্টিল-ফ্রেম বের করা, ফটো কাগজ বা ডিজিটাল ফাইলের ফ্রেম মুদ্রণ, অডিও-ভিডিওর নির্দিষ্ট অঞ্চল ট্র্যাক করে তথ্য নিয়ে তা ল্যাবে পরীক্ষা করে অপরাধী শনাক্ত করা।
দুদকের তথ্য-প্রযুক্তি ও সাইবার ইউনিটের পরিচালক রাজিব হাসান বলেন, আমরা এনটিএমসি, সিআইডিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ফরেনসিক ল্যাবের কার্যক্রম দেখেছি। এরপর অনেকদিন ধরেই কমিশন চেষ্টা করে আসছে তাদের চেয়ে উন্নত কোনো ফরেনসিক ল্যাব করা যায় কি না। সে লক্ষ্যে কমিশন প্রকল্পের কাজ গুছিয়ে এনেছে। ফরেনসিক ল্যাবের কার্যক্রম শুরু হলে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, হুন্ডি ও মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধে জড়িতদের বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্তে নতুন মাত্রা আসবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
দুদকের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অনুসন্ধান তদন্তে নতুন মাত্রা আনতে ২০১৮ সালের মার্চে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পে হাত দেয় দুদক। পরে একটি শক্তিশালী কমিটির মাধ্যমে প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। ডিজিটাল সিস্টেমে দুর্নীতির আলামত সংগ্রহ করে তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা আসামির বিরুদ্ধে আদালতে উপস্থাপনের লক্ষ্যে শুরু করা এ প্রকল্পের চূড়ান্ত রূপ পায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর। দুদকের এক অফিস আদেশে কমিশনের পক্ষে সার্বক্ষণিকভাবে ফরেনসিক ল্যাবের জন্য পরিচালক রাজিব হাসানকে ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
দুদকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ডিআইজি মিজান ও দুদকের একজন পরিচালকের মধ্যকার ঘুষ লেনদেন সংক্রান্ত কথোপকথনের ফরেনসিক ল্যাব টেস্টের জন্য এনটিএমসির সহায়তা নেয়া হয়। এখন থেকে এ ধরনের কল রেকর্ডের সত্যতা নিরূপণের জন্য এনটিএমসি, সিআইডি বা অন্য কোনো সংস্থায় যেতে হবে না। ফরেনসিক ল্যাবের কার্যক্রম ছাড়াও দুদক যে কোনো ব্যক্তির কথোপকথন রেকর্ড, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণের কার্যক্রমও পরিচালনা করছে বলে জানান তিনি।
অবৈধ সম্পদ ও মানি লন্ডারিংয়ের অনুসন্ধান ও তদন্ত চলাকালীন তদন্ত কর্মকর্তারা যেসব ডিভাইস জব্দ করেন, তা তারা ফরেনসিক ল্যাবে একটি আবেদনের মাধ্যমে জমা দিলে তাদের একটি প্রতিবেদন দেয়া হবে। যা তারা বিচার শুনানিতে আদালতেও ব্যবহার করতে পারবেন। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, মোবাইল ফোনের ফরেনসিকের যন্ত্রপাতি প্রত্যেক সেটের জন্য আলাদা থাকবে। এর কাজ হল সেটের ফরেনসিক পরীক্ষা নিশ্চিত করা।
দুদক পরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, দুদকের কর্মকর্তারা অনুসন্ধান ও তদন্তের প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা মামলার আসামির ডিভাইস জব্দ করে এনে ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা করতে পারবেন। তাদের ডিভাইসের তথ্য বিশ্লেষণ করে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হবে। ল্যাব বিশ্লেষণ করে প্রাপ্ত তথ্য রিপোর্ট আকারে অনুসন্ধান ও তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে পাঠাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ল্যাবের কার্যক্রম শুরুর পরপরই অন্তত এক ডজন মামলার আসামির বিভিন্ন ধরনের ডিভাইসের ফরেনসিক পরীক্ষা করা হবে। এই তালিকায় সাবরিনা, সাহেদ, পিকে হালদার, স্বাস্থ্য খাতের আবজাল ও মালেকের নাম রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ডাক বিভাগের মহাপরিচালক ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ ওই দফতরের দুজন পরিচালকের নামও রয়েছে। তাদের অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
Discussion about this post