জাকিয়া আহমেদ, বাংলা ট্রিবিউন
বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির দিন যতই যাচ্ছে ততই হার্ড ইমিউনিটি তত্ত্ব প্রসঙ্গটি জোরেশোরে উঠে আসছে। সম্প্রতি রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)-এর যৌথভাবে করা এক গবেষণার পর হার্ড ইমিউনিটির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে হার্ড ইমিউনিটি কোনও স্বীকৃত বিষয় নয়, তবে অনেকেই করোনাকে প্রতিরোধে একে ‘একটি উপায়’ বলে মনে করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হার্ড ইমিউনিটির জন্য ঝুঁকি নিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষকে সংক্রমিত হতে দেওয়ার অনৈতিক চিন্তা করা যাবে না।
প্রসঙ্গত, একমাত্র সুইডেনই হার্ড ইমিউনিটি তৈরির জন্য করোনার বিস্তার করতে দেয়। কিন্তু সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। সুইডিশ সরকার ধারণা করেছিল, স্টকহোমের ৪০ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবে এবং মে মাসের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে। কিন্তু আগস্টের এক গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র ১৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী সংক্রমিত হয়েছে।
ভেড়ার পাল
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হার্ড শব্দ এসেছে ভেড়ার পাল থেকে। একসময় ভেড়ার পালকে সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য টিকা দেওয়া হতো। ভেড়ার একটি পালের মধ্যে ১০০ ভেড়াকে টিকা দেওয়া হতো, বাকি ২০টিকে দেওয়া হতো না। তারপর সেই পালের মধ্যে এক ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠতো, বাকিদের মধ্যে সেটি প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করতো। সেখান থেকে হার্ড ইমিউনিটি শব্দটি আসে।’
‘মানুষের ক্ষেত্রে বলা যায়, একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে যদি নির্দিষ্ট অনুপাতে ভ্যাকসিন বা টিকা দেওয়া যায় তাহলে ওই কমিউনিটিতে আর সংক্রমণ হয় না। একেই বলে হার্ড ইমিউনিটি। তবে হার্ড ইমিউনিটি হতে হলে একেকটি রোগে একেক রকম পার্সেন্টেজ অব পপুলেশনের উপর প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মাতে হবে। এটা নির্ভর করে রোগের ইনকিউবিশন পিরিয়ড (সুপ্তিকাল) এবং সংক্রমণের সময়কলের ওপর।’ বলেন অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘পোলিও রোগে হার্ড ইমিউনিটি করতে হলে কত ভাগ মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে হবে সেটা নির্ধারিত। ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ মানুষকে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করানো গেলে সেখানে হার্ড ইমিউনিটি ডেভলপ করবে। কিন্তু করোনার বেলায় কত ভাগ মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকতে হবে সেটি নিয়ে এখনও আলোচনা হচ্ছে।’
কীভাবে কাজ করে হার্ড ইমিউনিটি
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ভ্যাকসিন দেওয়া ছাড়া কেবলমাত্র স্বাভাবিক সংক্রমণের মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে গেলে অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটবে। আবার স্বাভাবিক সংক্রমণ পর একটা বিপুল জনগোষ্ঠীকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠতে হবে। তবে একেবারেই নতুন এই ভাইরাসের বেলায় অ্যান্টিবডি বা সুরক্ষার ব্যাপ্তিকাল বা সময়কাল কতটুকু সেটাও অজানা।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘স্বাভাবিক এবং কৃত্রিম এ দুই উপায়ের মধ্যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ৮০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হয়ে গেলে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়। অপরদিকে, ৮০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া গেলে সেখানে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করা যাবে।’
স্বাভাবিক হার্ড ইমিউনিটি অনৈতিক
মেলবোর্নের ডেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অনুষদের মহামারি বিশেষজ্ঞ ক্যাথরিন বেনেট স্বাভাবিক হার্ড ইমিউনিটি বিষয়ে সতর্ক করে বলেছেন, ‘অনেক বেশি মানুষের এই মৃত্যুঝুঁকি নেওয়া যাবে না। যেহেতু ভাইরাসটির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি, তাই হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছানোর জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষের আক্রান্ত হওয়াকে আমরা মেনে নিতে পারি না।’
একইভাবে করোনা মহামারি প্রতিরোধে হার্ড ইমিউনটির চিন্তা করা অনৈতিক বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসিস। তিনি বলেন, ‘হার্ড ইমিউনিটির এ দৃষ্টিভঙ্গি নৈতিকভাবে সমস্যাযুক্ত। বৈশ্বিক মহামারি দূরের কথা, জনস্বাস্থ্যের ইতিহাসে কোনও রোগের প্রভাব ঠেকাতে হার্ড ইমিউনিটি ব্যবহার করা হয়নি।’
এ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘আমাদের দেশে সাড়ে ১৩ থেকে ১৪ কোটি মানুষ সংক্রমিত হলে স্বাভাবিকভাবে অথবা যদি ভ্যাকসিন দেওয়া যায় তাহলেই কেবল হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে। কিন্তু এত এত মানুষকে আমরা ভ্যাকসিন কবে দিতে পারবো জানি না।’
হার্ড ইমিউনিটি একটি উইয়ার্ড আইডিয়া মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান খসরু বলেন, ‘এটা কোনও অ্যাপ্রোচ নয়, সিম্পলি আনএথিকাল।’
তিনি বলেন, ‘মানুষকে একটি অপরিচিত ভাইরাসের মুখোমুখি করে হার্ড ইমিউনিটির চেষ্টা পৃথিবীতে একমাত্র সুইডেন করেছিল। তাদের আলাদা পদ্ধতি ছিল বলে তারা এই চেষ্টা করতে পেরেছে। তারপরও তাদের যে মৃত্যুহার সেটা স্কেন্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মধ্যে বেশি হয়েছে।
‘পৃথিবীর ইতিহাসে হার্ড ইমিউনিটি বহুবার অ্যাটেন করা হয়েছে কিন্তু তার কোনওটার সঙ্গেই করোনার ক্ষেত্রে মেলে না। হার্ড ইমিউনিটি কেবলমাত্র ভ্যাকসিন দিয়ে সম্ভব হবে। কিন্তু সেটা বহুদূর, বহু বছর বাকি। আর আমাদের দেশে যেভাবে হার্ড ইমিউনিটির কথা বলা হচ্ছে সেটা খুবই অনৈতিক। একজন মানুষকে মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে রেখে বাকিদের ইমিউন করার চিন্তা কোনও আইডিয়া-ই না।
‘করোনা এখন একটি বিশ্বযুদ্ধের মতো। আর কোনও অস্ত্র আমাদের ঘরে রাখা যাবে না। যত রকমের সুযোগ রয়েছে– অ্যান্টিজেন টেস্ট-অ্যান্টিবডি টেস্ট, মাস্ক, সামাজিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধির মতো অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করার কথা কোনও ভাবেই কাম্য হতে পারে না।’
হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন
অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্ত দিয়ে হার্ড ইমিউনিটি সম্ভব নয়। আবার যে প্রতিরোধ ক্ষমতা বা অ্যান্টিবডির কথা বলা হচ্ছে, সেটি টেকসই কিনা তা নিয়েও সঠিক তথ্য নেই। যদি কারও শরীরে তিন মাসের জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তার পর তো আর সেটা থাকবে না। কিন্তু যখন সেটা থাকবে না, তখন আর হার্ড ইমিউনিটি থাকলো না। তারা আবার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেলো।
‘আবার যারা উপসর্গহীন অথবা মৃদ্যু সংক্রমিত, তাদের মধ্যে প্রতিরোধক্ষমতা বা অ্যান্টিবডি কতখানি? সেটি আদৌ প্রটেকটিভ কিনা? এসব প্রশ্নের উত্তর ঠিকভাবে পাওয়া গেলে বলা যাবে, হার্ড ইমিউনিটি হতে পারে। নয় তো বলা যাবে না, করোনাতে হার্ড ইমিউনিটি হবে।
‘তাই জোর দিতে হবে নন ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্টারভেশনের দিকে। তবে এখানে স্বাস্থ্য বিভাগকে এজন্য দায়িত্ব নিতে হবে। টেস্টিং-ট্রেসিং-অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি টেস্ট চালু করা-আইসোলেশন-কোয়ারেন্টিন এগুলো না করা গেলে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’
সিদ্ধান্তে আসা কঠিন
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, ‘যে সেরো পজিটিভিটি দেখছি সেটা নিয়ে আরও বিস্তৃত আকারে গবেষণা করতে হবে। আমাদের নমুনা পরীক্ষার যে সংখ্যা তা দিয়ে আসলে কোনও সিদ্ধান্তে আসা কষ্টসাধ্য। খুব দ্রুতই বস্তি এলাকায় এই কাজ শুরু করছি। সব জেলা থেকে আমাদের যে তথ্য সংগ্রহ হয়েছে সেটা বর্তমানের সঙ্গে মেলালে জাতীয় পর্যায়ের জন্য একটা ফিগার দাঁড় করাতে পারবো। আজ যে গবেষণা ফলাফল জানানো হয়েছে সেটা প্রাথমিক পর্যায়ের তথ্য। যেখানে খুব অল্প সংখ্যক নমুনা সংগ্রহ হয়েছে। এটা দিয়ে বাংলাদেশ হার্ড ইমিউনিটির পথে হাঁটছে কিনা সে সিদ্ধান্তে আসা খুব কঠিন হবে।’
Discussion about this post