ড. মাহবুব উল্লাহ্
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের অনেক গর্ব। জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ইতিহাস ধাপে ধাপে এগিয়ে চলে।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে কৃষক অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গের জনগণ উন্নত জীবনমানের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, কলকাতাকেন্দ্রিক ভদ্রলোকরা বঙ্গভঙ্গ মেনে নিতে পারেনি। কারণ তারা বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে কৃষক বাংলার ওপর তাদের আধিপত্য ও শোষণ দুর্বল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল। এ কারণে তারা বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য জেদ ধরল এবং তুমুল আন্দোলন শুরু করল।
শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করার ঘোষণা দেয়। এর ফলে পূর্ববঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষা এবং সামাজিক উন্নয়নের আলোকবঞ্চিত মুসলিম কৃষক সমাজ নিদারুণ হতাশা অনুভব করে।
ব্রিটিশ সরকার মুসলিম কৃষক জনগোষ্ঠীর হতাশা নিরসনের জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেয়। এ ব্যাপারেও হিন্দু ভদ্রলোকরা প্রবল বাধার সৃষ্টি করে। হিন্দু ভদ্রলোক বলতে সাধারণত হিন্দু সমাজের উচ্চবর্ণের ব্যক্তিরা, বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের বোঝানো হয়। ইতিহাস লেখকদের অনেকেই হিন্দু ব্রাহ্মণ কথাটি ব্যবহার না করে একাডেমিক ভাষা হিসেবে ‘ভদ্রলোক’ শব্দটি বেছে নেয়। এ ব্যাপারে পরলোকগত জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমদ একটি গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
এ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, কলকাতার ভদ্রলোকরা প্রথম থেকেই বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটি মুসলমানি বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থাৎ একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে মুক্ত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সে ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় হবে না। এ ব্যাপারে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখার্জির নেতৃত্বে আবারও পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপপ্রয়াস শুরু হয়।
কিন্তু তৎকালীন মুসলিম নেতারা বিশেষ করে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ এবং নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর অক্লান্ত চেষ্টার ফলে শেষ পর্যন্ত ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার তার লেখা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : পূর্ব কথা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন যে হিন্দুরা ভালো চোখে দেখেননি, এ কথা আগেই বলেছি। কারণ হিন্দুদের বিশ্বাস ছিল বঙ্গ বিভাগ রোহিত করায় মুসলমানদের যে ক্ষতি হয়েছে অনেকটা তা পূরণ করার জন্যই এ নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।
যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় পদে হিন্দু শিক্ষকরাই অধিষ্ঠিত ছিলেন, তথাপি কোর্টের হিন্দু সভ্যরা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রীতির চোখে দেখেননি। বাইরে এ বিষয়ে যে আলোচনা হতো কোর্টের সভায় হিন্দু সভ্যদের বক্তৃতায় তা প্রতিধ্বনিত হতো। রমনার যেসব বড় বড় বাড়ি দখল করে আমরা শিক্ষকরা বাস করছিলাম, এটাতেই তাদের ঘোরতর আপত্তি ছিল।’ হিন্দু ভদ্রলোকদের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
কিন্তু ইতিহাসের অগ্রযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এক শক্তিশালী দুর্গ। রাজনৈতিক বিবেচনার দিক থেকে দেখলে বিশ্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ গৌরব কখনও ম্লান হবে না।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের শিক্ষক ভবতোষ দত্তও ছিলেন অত্যন্ত নামকরা অর্থনীতিবিদ। ভারতের নামকরা একগুচ্ছ বাঙালি অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের শ্রেণিকক্ষের ছাত্র। ভবতোষ দত্ত ‘আট দশক’ নামে তার আত্মজীবনী রচনা করেছেন। একজন সফল ও অনুকরণীয় অধ্যাপকের জীবন সম্পর্কে জানতে হলে এ গ্রন্থটি পাঠ করা জরুরি। ভবতোষ দত্ত তার শিক্ষকতার জীবন শুরু করেন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে।
তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজেও বহুদিন অধ্যাপনা করেছেন। তার আত্মজীবনীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গও এসেছে। এ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, প্রতিষ্ঠার সময় এ বিশ্ববিদ্যালয়কে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় বলে উপহাস করা হতো। তারপর যখন ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটল তখন নতুন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হল ধাক্কা বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থাৎ ভারত যেভাবে স্বাধীন হয়েছে তার ফলে হিন্দু শিক্ষকদের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করা সম্ভব ছিল না। নামকরা হিন্দু অধ্যাপকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার ফলে ভয়ানক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। যে শূন্যতা পূরণ করা খুব সহজসাধ্য ছিল না। এ অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিহিত করা হয়েছিল ‘ফক্কা’ বিশ্ববিদ্যালয়।
ড. কাজী মোতাহার হোসেন তার ‘বিজ্ঞানচর্চা সত্যেন্দ্রনাথ বোস’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘১৯২১ সালে নোয়াব স্যার সলিমউল্লাহ বাহাদুরের উদ্যোগে ‘ঢাকা কলেজ’কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা হয়। সে সময় ঢাকা কলেজের বিএ, বিএসসি ও এমএসসি ক্লাসের তৎকালীন সুদক্ষ অধ্যাপকদের সহিত দেশ-বিদেশ থেকে আরও বহুসংখ্যক সুযোগ্য অধ্যাপক নিযুক্ত করে বাংলার (তথা ভারতবর্ষের) এই প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ক্যামব্রিজের অনুকরণে নিরীক্ষামূলক আদর্শ সর্ববিদ্যালয়রূপেই গড়ে তোলা হয়।
এ উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষ থেকে যে বিদ্বানমণ্ডলীর সমাগম হয়, তাদের মধ্যে ছিলেন পদার্থবিদ্যাবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বোস, ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, দার্শনিক হরিদাস ভট্টাচার্য, রাসায়নিক জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, ঐতিহাসিক এএফ রহমান, সংস্কৃতজ্ঞ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলাবিদ চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, সংস্কৃতজ্ঞ হীরালাল দে, ঐতিহাসিক কালিকারঞ্জন কানুনগো, সংস্কৃত ও পালিবিদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, পদার্থবিদ্যাবিদ রাধাকৃষ্ণান, ব্যবসা-বাণিজ্যবিদ পনোক্তি কর, উদ্ভিদবিজ্ঞানী মাহেশ্বরী, গণিতজ্ঞ বিজয় রাঘবন প্রমুখ : আর ঢাকা কলেজেই ছিলেন গণিতজ্ঞ ভূপতি মোহন সেন ও বংকিম দাস ব্যানার্জি, ইতিহাসে র্যামস বোথাম ও অশ্বিনী মুখার্জি, ইংরেজিতে সত্যেন ভদ্র, বাংলায় অক্ষয় কুমার দাস গুপ্ত, পদার্থবিদ্যায় ডব্লিউ এ জেংকিনস, ইতিহাসে পরেশচন্দ্র চক্রবর্তী (?), সংস্কৃতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ইংরেজিতে আর্চবোল্ড বটমলি ও টার্নার, দর্শনে ল্যাংলী, রাষ্ট্রনীতিতে টি টি উইলিয়ামস প্রমুখ।
অবশ্য বাংলাদেশও তখন ভারতবর্ষের অন্তর্গত ছিল।’ সহজেই অনুমেয় যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর এসব নামকরা অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি নিয়ে ভারতে চলে যান। অবশ্য কয়েকজন ইংরেজ অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যান।
পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তা পূরণ করতে বিশাল এক চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি নবযাত্রার সূচনা হল। ধীরে ধীরে বেশ কিছু জ্ঞানী ও গুণী মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করলেন।
এদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন- ড. মোয়াজ্জেম হোসেন, ড. আহমদ হোসেন দানী, ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ড. এম এন হুদা, ড. আবু মাহমুদ, ড. আনিসুর রহমান, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ড. আনিসুজ্জামান, ড. আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ ড. মোজাফফর আহমদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, প্রফেসর মোকাররম হোসেন খন্দকার, ড. আবদুল মতিন চৌধুরী, ড. নাজমুল করিম, ড. আহমদ শরীফ, প্রফেসর জেএস টার্নার প্রমুখ।
ফক্কা হয়ে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবারও কয়েক বছরের মধ্যে তার হারিয়ে যাওয়া ঔজ্জ্বল্য অনেকটাই উদ্ধার করতে সক্ষম হল। সবচেয়ে বড় কথা হল, এসব অধ্যাপক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের কাছে পরিচিত ছিল। জ্ঞান-বিদ্যা ও বুদ্ধিতে এরা সুযোগ্য ছিলেন। একাডেমিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে এদের দেশব্যাপী পরিচিতি ছিল।
পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের পাঠদানের পাশাপাশি গবেষণা কাজও চালিয়ে যেতে হয়। তাদের গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত হয়। নিছক পিএইচডি ডিগ্রির বলে পদোন্নতি পাওয়া সম্ভব হয় না। তবে এখনও পাশ্চাত্যের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রিবিহীন ফুল প্রফেসর আছেন। এরা অনেক মূল্যবান গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এছাড়া প্রায় সব অধ্যাপকই মূল্যবান গ্রন্থের রচয়িতা।
এসব গ্রন্থ মানবজাতির চিন্তার জগতে নতুন চিন্তাসম্ভার যুক্ত করেছেন। তাদের রচিত গ্রন্থের মুখবন্ধ থেকে জানা যায় একেকটি গ্রন্থ রচনায় ৯-১০ বছর লেগেছে। গ্রন্থের রচয়িতারা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে একগুচ্ছ পণ্ডিত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করার রীতি অনুসরণ করেন। জ্ঞানচর্চা যে একটি যৌথ প্রয়োগের ফসল তা কৃতজ্ঞতা স্বীকারপত্র থেকে বোঝা যায়। বাংলাদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতা থেকে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, জ্ঞানচর্চায় আমরা খুব উৎসাহী নই। জ্ঞান উৎপাদনে আমাদের প্রচণ্ড অনীহা।
তবে এ কথা সত্য যে, এখনও বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আছেন, যারা বিপরীত স্রোতে দাঁড় বেয়ে চলছেন। তারা অবশ্যই নমস্য। তবে যতই দিন যাচ্ছে আমাদের দেশের অধ্যাপকরা জ্ঞানচর্চায় পিছিয়ে পড়ছেন। পাকিস্তান আমলে যারা অধ্যাপনা করতেন তাদের অনেকেই হয়তো আজকাল যেভাবে সংখ্যা গুনে গবেষণা প্রবন্ধের হিসাব কষা হয় সে ধরনের চর্চায় অভ্যস্ত ছিলেন না। কিন্তু তারা প্রচুর পড়াশোনা করতেন। ফলে তারা শিক্ষার্থীদেরও অনেক গভীরে প্রবেশ করে পাঠ্য বিষয় সম্পর্কে জানাতে সক্ষম ছিলেন।
সে সময় সামাজিক বিজ্ঞানে বেশ কিছু অধ্যাপক ছিলেন, যারা একটি লেকচারে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব ও দর্শনের আকর্ষণীয় সমাহার ঘটিয়ে তাদের লেকচার উপস্থাপন করতেন। এর ফলে ছাত্ররা বুঝতে পারত জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে সেতুবন্ধ বিদ্যমান। এ সেতুবন্ধ বুঝতে পারাটা ধ্রুপদী জ্ঞান তত্ত্বেরই একটি মহত্তর প্রয়োগ ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি জাতীয় দৈনিক প্রধান শিরোনামে বলেছে, ‘কলেবরে বিশাল, গুণমানে নিচে’। ইমেরিটাস অধ্যাপক জনাব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেবরে বড় হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মান ও গবেষণার দিক দিয়ে উন্নতি হয়নি। এটা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের শিক্ষাক্ষেত্রের চিত্রও একই।’ গত দুই দশকে শিক্ষক নিয়োগ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। শিক্ষার্থী বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। শতবর্ষে এসে শিক্ষা ও গবেষণায় ম্রিয়মাণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি সে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে যখন এমন হতাশাব্যঞ্জক মন্তব্য করা হয়, তখন খুব কষ্ট পাই।
এখন পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নির্ণয় করার জন্য র্যাংকিংয়ের ব্যবস্থা আছে। ইউএস র্যাংকিংয়ে মোট এক হাজার তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান ২০১২ সালে ছিল ৬০১তম, ২০১৪-২০১৮ সাল ছিল ৭০০-৭৫০-এর মধ্যে এবং ২০১৯-এর পর আরও অবনতি ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৮০১-১০০০-এর মধ্যে। ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩১৫ কোটি টাকা। এ থেকে প্রতি বছর বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০-২১ এ দাঁড়িয়েছে ৮৭০ কোটি টাকা। এ বাজেটের ৮৬ শতাংশ অর্থ আসে মানুষের করের টাকা থেকে। দেশের ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় ১৯৭৩-এর আইন দ্বারা।
এ আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। কিন্তু এ আইনে বিভিন্ন পর্ষদ গঠিত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। এ নির্বাচন প্রথার সঙ্গে যখন দলীয় রাজনীতি যুক্ত হয়ে পড়ে তখন একাডেমির বিবেচনা গৌণ অবস্থানে চলে যায়। শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক আনুগত্য প্রাধান্য পায়। ফলে দুর্ভাগ্যজনক হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো ছাত্রকে পাস করার পর শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পথ প্রশস্ত করতে পরীক্ষায় নম্বর বেশি দেয়া হয়েছে। এটা এক ধরনের অতি নিকৃষ্ট দুর্নীতি। দল ভারী করার জন্য নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়, অথচ এ ধরনের বিভাগ খোলার পেছনে একাডেমিক যুক্তি অত্যন্ত দুর্বল।
জাতীয় দৈনিকটিতে তথ্য ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে কীভাবে একটি মূল বিভাগ থেকে আরও কয়েকটি বিভাগের জন্ম হয়েছে এবং নতুন বিভাগগুলোতে পাঠ্যসূচির অন্তর্গত বিষয়গুলোর অনেকটুকুই মূলত বিভাগে পড়ানো হতো। নতুন নতুন বিভাগ খোলার ফলে বেতন-ভাতা ও প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অবকাঠামোর ওপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাঠদানের জন্য শ্রেণিকক্ষ দুর্লভ হয়ে উঠছে। নতুন নতুন বিভাগ খোলা ভ্রান্তিবিলাসে মেতে ওঠার পরিবর্তে যদি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ঈড়ৎব বিভাগগুলোকে সমৃদ্ধ করার জন্য প্রাপ্ত বাড়তি অর্থ ব্যয় করা হতো তাহলে আমাদের উচ্চশিক্ষা আরও অর্থবহ হতে পারত।
দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। দল ভারী করার আত্মঘাতী নীতিতে জড়িয়ে না পড়ে আমরা যদি একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে পারতাম যে, কেবল সংখ্যাগত ব্যাপ্তি নয়, দেশের জন্য গুণগত মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। তবে এ রকম আশা খুব সহজে পূর্ণ হওয়ার নয়। কারণ জাতি হিসেবে আমরা মারাত্মকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছি।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ
Discussion about this post