তোফায়েল আহমেদ
জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারারুদ্ধ থাকাকালে বা তার অবর্তমানে জাতীয় চার নেতা- সর্বজন শ্রদ্ধেয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান বারবার জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। গভীর পরিতাপের বিষয় সমগ্র বিশ্বে যে কারাগারকে মনে করা হয় সবচেয়ে নিরাপদ স্থান সেই কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়; তারপর থেকে জাতীয় চার নেতা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দল-মত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার পরিচালনা করেন ও বিজয়ের লাল সূর্যটি ছিনিয়ে আনেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই ২৯ মার্চ রওনা করে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম আমাদের আগেই সীমান্ত অতিক্রম করেন এবং ১ এপ্রিল ভারতে পৌঁছান। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিল্লি যান এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করে বাস্তবোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ‘৬৯-এর অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু লন্ডন যান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারত সরকারের ভূমিকা নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জী বা মিস্টার নাথের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ‘৭১-এর শুরুতেই বঙ্গবন্ধু ঠিক করে রেখেছিলেন আমরা কোথায় গেলে সাহায্য পাব। ১৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের চারজনকে- শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও আমাকে বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠালেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে। সেখানে জাতীয় চার নেতাও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেন, ‘পড়ো, মুখস্থ করো।’ আমরা মুখস্থ করলাম একটি ঠিকানা- ‘সানি ভিলা, ২১, রাজেন্দ্র রোড, নর্দান পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এখানেই হবে তোমাদের জায়গা। ভুট্টো-ইয়াহিয়া ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ক্ষমতা দেবে না। আমি নিশ্চিত ওরা আক্রমণ করবে। আক্রান্ত হলে এটাই হবে তোমাদের ঠিকানা। এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করবে।’
জাতীয় পরিষদ সদস্য চিত্তরঞ্জন সুতারকে তিনি আগেই কলকাতায় পাঠিয়ে ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডাক্তার আবু হেনাকে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন। সেই পথেই ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান সাহেব, মনি ভাই এবং আমাকে আবু হেনা সাহেব নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা ৪ এপ্রিল কলকাতা পৌঁছে রাজেন্দ্র রোডের সানি ভিলায় অবস্থান করি। ৮নং থিয়েটার রোডে অবস্থান করতেন জাতীয় চার নেতা। কলকাতায় মুজিব বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে থাকার সুবাদে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে ‘৭১-এর ১০ এপ্রিল অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং উপরাষ্ট্রপতি তথা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন তাজউদ্দীন আহমদ। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসনবিষয়ক মন্ত্রী হন। ১৭ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন। সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ দূরদর্শিতার সঙ্গে সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। আমরা চারজন মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক ছিলাম। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বর্ডারে বর্ডারে ঘুরেছি, রণাঙ্গনে ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়েছি। একসঙ্গে কাজ করেছি। আমার ক্যাম্প ছিল ব্যারাকপুর, মণি ভাইর আগরতলা, সিরাজ ভাইর শিলিগুড়ি, আর রাজ্জাক ভাইর মেঘালয়। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বেশ কয়েকবার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। মেজর জেনারেল ওবানের নেতৃত্বে দেরাদুনে ছিল আমাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা দুর্গাপ্রসাদ ধর তথা ডিপি ধর আমাদের কাজের সমন্বয় করতেন। এছাড়াও সমন্বয়ক হিসেবে ছিলেন মেজর জেনারেল সরকার। এই দু’জনসহ ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জী তথা মিস্টার নাথ- এই তিনজন আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করেছেন।
দেশ স্বাধীনের পর ‘৭১-এর ১৮ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে একটি বিশেষ হেলিকপ্টারে আমি এবং রাজ্জাক ভাই বিজয়ীর বেশে প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করি। ২২ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকার ফিরে এলে জাতীয় চার নেতাকে আমরা বীরোচিত সংবর্ধনা জানাই। ৯ মাস ১৪ দিন কারারুদ্ধ থাকার পর পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে বিজয়ের পরিপূর্ণতায় জাতির পিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ‘৭২-এর ১০ জানুয়ারি। পরদিন ১১ জানুয়ারি তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা বিষয়ে সমস্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাবেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং; সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী; তাজউদ্দীন আহমদ অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী; ক্যাপ্টেন মনসুর আলী যোগাযোগমন্ত্রী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেব ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হবার। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকেছি শেষ দিন পর্যন্ত।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর জাতীয় চার নেতাসহ আমরা ছিলাম গৃহবন্দি। খুনিচক্রের হোতা মোশতাক জাতীয় নেতা মনসুর আলীকে বঙ্গভবনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৫ আগস্টের পর দিন খুনিরা আমার বাসভবন থেকে আমাকে তুলে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। ২৩ আগস্ট পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই এ চৌধুরীর মাধ্যমে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শ্রদ্ধেয় নেতা জিল্লুর রহমান এবং আমাকে বঙ্গভবনে নিয়ে যায়। সেখানে খুনি মোশতাক আমাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে নানারকম প্রস্তাব দিলে আমরা খুনির সে সব প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। আগস্টের ২২ তারিখ জাতীয় চার নেতাসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাইন দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছিল হত্যা করার জন্য। ঘাতকের দল শেষ পর্যন্ত হত্যা করেনি। পরে নেতৃবৃন্দকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। গৃহবন্দি অবস্থা থেকে একই দিনে আমাকে, জিল্লুর রহমান ও আবদুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোণে অবস্থিত পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ৬ দিন বন্দি রেখে আমার ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে খুনিচক্র আমাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে চোখ ও হাত-পা চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করে। পরে অর্ধমৃত অবস্থায় পুলিশ কন্ট্রোল রুমে রেখে আসে। সিটি এসপি আবদুস সালাম ডাক্তার এনে আমার চিকিৎসা করান। পরে জিল্লুর রহমান ও প্রিয় নেতা রাজ্জাক ভাইকে কুমিল্লা কারাগারে আর আমাকে ও আবিদুর রহমানকে ময়মনসিংহ কারাগারে পাঠায়। যেদিন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়, সেদিন আমি ময়মনসিংহ কারাগারে কনডেম সেলে, ফাঁসির আসামিকে যেখানে রাখা হয়। তখন আমাদের দুঃসহ জীবন! সহকারাবন্দি ছিলেন ‘দি পিপল’ পত্রিকার এডিটর জনাব আবিদুর রহমান, যিনি ইতোমধ্যে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। ময়মনসিংহ কারাগারের জেল সুপার ছিলেন নির্মলেন্দু রায়। কারাগারে আমরা যারা বন্দি তাদের প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল। বঙ্গবন্ধু যখন বারবার কারাগারে বন্দি ছিলেন, নির্মলেন্দু রায় তখন কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু তাকে খুব স্নেহ করতেন। সেদিন গভীর রাতে নির্মলেন্দু রায় আমার সেলে এসে বলেন, ‘ঢাকা কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা কারাগারের চারদিক পুলিশ দ্বারা বেষ্টন করে রেখেছি, জেল পুলিশ ঘিরে রেখেছে। এসপি সাহেব এসেছেন আপনাকে নিয়ে যেতে।’ এসপি এমআর ফারুক আমাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, আমি বলেছিলাম, এভাবে তো যাওয়ার নিয়ম নেই। আমি এখান থেকে যাব না। জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের দুঃসংবাদটি শুনে মন বেদনাভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
ইতিহাসের মহামানব জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। বঙ্গবন্ধুর দুটি স্বপ্ন ছিল, একটি স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। স্বাধীনতার স্বপ্ন তিনি পূরণ করেছেন। স্বপ্নের বাংলাদেশকে তিনি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, জেলহত্যা দিবসের শোককে শক্তিতে পরিণত করে জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতার আরাধ্য স্বপ্ন বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অচিরেই আমরা দেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করব।
আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ।
Discussion about this post