ড. মো. সহিদুজ্জামান
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষক নিয়োগে অভিন্ন নীতিমালা করার জন্য ইউজিসি তথা সরকার নড়েচড়ে বসেছে। এটিকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা ভাবছে কর্তৃপক্ষ। অভিন্ন নীতিমালাটির খসড়া পড়ে মনে হয়েছে নীতিমালার শিরোনামটি—‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি/পদোন্নয়ন।’ এর সঙ্গে ‘সুযোগ-সুবিধাসমূহ’ কথাগুলো সংযুক্ত করলে ভালো হতো। বিষয়গুলো গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবতার আলোকে বিশ্লেষণ করা সহজ হতো শিক্ষকদের জন্য। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, নীতিমালাটি শিক্ষার মানোন্নয়নে নয়, খুব সূক্ষ্মভাবে শিক্ষকদের অযাচিত নিয়ন্ত্রণ ও সুবিধাবঞ্চিত করার একটি প্রয়াস মাত্র। যেমনটি করা হয়েছে সরকারি কলেজের (মেডিক্যাল কলেজসহ) জন্য। এটি করায় কলেজের শিক্ষার মান কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে জানি না, তবে শিক্ষকদের অযাচিত নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। উদ্দীপনা হারিয়ে শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানো, কোচিং করানো, মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকরা প্রাইভেট প্র্যাকটিসসহ বিভিন্ন কর্মে লিপ্ত হয়েছেন। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তখন আমার বাবার সমবয়সী একজন একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অবসরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিষয়টি এমন হলে শিক্ষার মানোন্নয়ন আশা করা অবান্তর হবে বলে আমার বিশ্বাস।
অভিন্ন নীতিমালার খসড়াটির ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান সমান নয় এবং এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে এক ধরনের বৈষম্য বিরাজমান, যা দূর করা দরকার।’ দেশের শিক্ষার মান সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনোই সমান হবে না, হলে র্যাংকিংয়ের ব্যবস্থা থাকত না। বর্তমানে আমি আমেরিকার যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি তা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর মান আমেরিকার অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো। বিশ্বের কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অভিন্ন নীতিমালা নেই, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব স্বকীয়তায় চলে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ন্যূনতম মান বজায় রাখতে হলে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষক থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। তাই শিক্ষক নিয়োগে ইউজিসি বা সরকারের একটি নির্দেশনা থাকা উচিত। যেমন—পিএইচডি ছাড়া বিশ্বের কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না, আবার পিএইচডি ও মানসম্মত গবেষণা প্রকাশনা ছাড়া কেউ কখনো প্রফেসর হতে পারেন না। তবে শিক্ষা ছুটি ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো নির্ভর করে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আইন ও নিয়ম-নীতির ওপর।
অভিন্ন নীতিমালায় কিছু অসংগতি ও অযাচিত বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে।
এক. অভিন্ন নীতিমালায় প্রভাষক পদের জন্য এসএসসিতে ৫ ও এইচএসসিতে ৪.৫-সহ মোট জিপিএ ৯.৫ থাকার কথা বলা হয়েছে। দেখা যায়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম জিপিএ ৮ চাওয়া হয়। যে শিক্ষার্থীটি জিপিএ ৮ বা ৯.৫-এর কম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো তাকে শুরুতেই বলে দেওয়া হলো তুমি শিক্ষক হওয়ার যোগ্য নও।
দুই. অভিন্ন নীতিমালা অনুযায়ী স্নাতকোত্তর পাস করে প্রভাষক পদে আবেদন করতে হবে। যেখানে স্নাতক পাস করে বিসিএস দিয়ে নবম গ্রেডে (অষ্টম জাতীয় স্কেল অনুযায়ী) যোগদান করা যায়, সেখানে স্নাতকোত্তর পাস করে একজন প্রভাষককে নবম গ্রেডে যোগদান করতে হলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা এ পেশায় আসবেন না। এ ছাড়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক কোর্স (এমবিবিএস, ডিভিএম) চার বছরের অধিক হওয়ার অসংগতি দেখা দিয়েছে।
তিন. নীতিমালা অনুুযায়ী একজন শিক্ষকের চাকরিজীবনে সর্বোচ্চ দুবার আপগ্রেডেশন করা যাবে। অর্থাৎ একজন শিক্ষক প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক এবং সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক হতে যদি তিনি দুবার আপগ্রেডেশন সুবিধা নেন, পরবর্তী সময়ে অধ্যাপকের পদ শূন্য না থাকলে তিনি সহযোগী অধ্যাপক (গ্রেড-৪) হিসেবেই অবসরে যাবেন। ভাগ্য ভালো হলে হয়তো বা অবসরে যাওয়ার আগে গ্রেড-৩ অধ্যাপক হতে পারবেন, তবে গ্রেড-১ অধ্যাপকে যাওয়ার সুযোগ একেবারেই ক্ষীণ হবে। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী হয়ে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যদি দেশের সর্বোচ্চ গ্রেডটিতে যাওয়ার সুযোগ না পান, তাহলে কেন মেধাবীরা এ পেশায় আসবেন? আবার শূন্য পদ থাকা অবস্থায় আপগ্রেডেশন করা না গেলে বৈষম্যের শিকার হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ দুই বন্ধু একই সময়ে একই বিভাগে একই পদে যোগদান করলেন, আপগ্রেডেশনের সুবিধা না থাকায় এবং পরবর্তী পদের জন্য মাত্র একটি পদ শূন্য থাকায় দুজনের একজন পদোন্নতি পাবেন, অন্যজন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হবেন।
চার. শিক্ষা ছুটির ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে পূর্ণ বেতনে বা সবেতনে একজন শিক্ষক মাস্টার্স ও পিএইচডি করার জন্য মোট পাঁচ বছর ছুটি পাবেন। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে গবেষণাসহ মাস্টার্স করতে সাধারণত দেড় থেকে দুই বছর এবং পিএইচডি করতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে। মোট পাঁচ বছরের অতিরিক্ত শিক্ষাকাল সক্রিয় চাকরিকাল হিসেবে গণ্য না হলে উন্নত বিশ্বে মাস্টার্স ও পিএইচডি করতে শিক্ষকরা অনুৎসাহিত হবেন, যা শিক্ষক ও শিক্ষার মানোন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পাঁচ. একজন শিক্ষক পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপের জন্য মাত্র দুই বছর সক্রিয় শিক্ষাকাল হিসেবে ছুটি পাবেন। মূলত পিএইচডির পর যেকোনো গবেষণামূলক কাজের ছুটি পোস্ট-ডক্টরাল ছুটির মধ্যে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে একজন শিক্ষককে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের প্রয়োজন হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজ চেষ্টায় ও যোগ্যতায় কঠিন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এসব ফেলোশিপ অর্জন করে জ্ঞান-বিজ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন এবং দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। যেখানে চীন, ভারত, পাকিস্তানের মতো দেশগুলো নিজ দেশের শিক্ষকদের প্রযুক্তি ও জ্ঞান আহরণে সরকারিভাবে বিদেশে পাঠাচ্ছে, সেখানে আমাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চিন্তা করা হচ্ছে। একজন শিক্ষককে ছুটি দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, সেটি দেশের ভেতরে হোক বা বাইরে হোক। কিন্তু তা সক্রিয় শিক্ষাকাল হিসেবে কেন বিবেচনা করা হবে না তা আমার বোধগম্য নয়।
ছয়. তিন পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রথমে লিখিত পরীক্ষা, তারপর ডেমোস্ট্রেশন ক্লাস ও পরে মৌখিক পরীক্ষা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রকাশনা ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করা হয়। কারণ শিক্ষক নিয়োগ অন্যান্য নিয়োগের মতো নয়। এখানে প্রার্থীর সংখ্যা সাধারণত কম থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি পদের জন্য মাত্র চার-পাঁচজনকে আবেদন করতে দেখা যায়। অল্পসংখ্যক প্রার্থীর মধ্য থেকে শ্রেষ্ঠ প্রার্থী বাছাই কঠিন কিছু নয়। এ জন্য লিখিত পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নৈতিকতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি।
সাত. প্রমোশনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগ্যতা হিসেবে মানসম্মত প্রকাশনা ও ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালের কথা বলা হয়েছে। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়, তবে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে প্রকাশনা করতে হলে মানসম্মত গবেষণাগার ও গবেষণা প্রয়োজন। আর মানসম্মত গবেষণার জন্য চাই পর্যাপ্ত গবেষণা অনুদান বা প্রকল্প। বর্তমান সরকার গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ালেও তা এখনো পর্যাপ্ত নয়। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত ফান্ড নিশ্চিত করা না গেলে মানসম্মত প্রকাশনা সম্ভব হবে না।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের প্রমোশন দ্রুত হয়ে থাকে এটি সত্য, তবে তা নতুন কোনো পরিবর্তনে নয় বা যোগ্যতা শিথিল করে নয়। বিদ্যমান যোগ্যতায় প্রমোশন হয়ে থাকে অর্থাৎ এসব ক্রাইটেরিয়া নতুন কোনো ক্রাইটেরিয়া নয়, এগুলো আগে থেকেই বিদ্যমান। তবে আগের দিনগুলোতে প্রশাসনিক জটিলতা ও সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধান বা কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে প্রমোশনে বেশ সময় লেগে যেত। সময়ের আবর্তে এসব জটিলতা নিরসন হওয়ায় বর্তমানে সঠিক সময়ে প্রমাশন পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রমোশন দ্রুত হওয়ায় কিছু বাড়তি টাকার বেতন ছাড়া তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় না। শিক্ষকতা একটি সম্পূর্ণ আলাদা পেশা, এটিকে অন্য পেশার সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। এখানে মেধাবীদের কোনো বিকল্প নেই।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা। শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দিয়ে এ খাতে বাজেট বৃদ্ধি করা। শিক্ষক ও গবেষকদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে জবাবদিহি নিশ্চিত করা একান্তই জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সরকার দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দিয়ে টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজে লাগাতে পারে। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালগুলোতে বাজেট বরাদ্দ দিয়ে টার্গেট ঠিক করে দিতে হবে এবং সেভাবে তা অর্জন করাতে হবে।
আমাদের অবশ্যই গুণগত মান, গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থান ও দেশের চাহিদা বিবেচনায় রেখে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগ খুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারের থিংকট্যাংকের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। ইউজিসিকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, তাহলে হয়তো বা বিশ্ববিদ্যায়গুলোর মানোন্নয়নে ফলপ্রসূ নজরদারি ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারবে।
লেখক : ফুলব্রাইট ভিজিটিং ফেলো, টাফটস্ ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা । অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
Discussion about this post