২০২০ সালের ফেলে আসা ক্লান্তি, হতাশা, ক্ষোভ, ভুল, দুঃখকে দূরে সরিয়ে দিয়ে নতুন উদ্যমে পথচলার বাসনা নিয়ে পুবাকাশে উঠেছে ২০২১ সালের নতুন সূর্য।
এবার নতুন বছর এসেছে ফের করোনা সংক্রমণের নতুন মাত্রার শঙ্কা নিয়ে। সদ্য বিদায়ী বছরটিতে গোটা বিশ্ব করোনো দুর্যোগে বিপর্যস্ত । আমরাও এর বাইরে নই। ইতোমধ্যে করোনার শুধু দ্বিতীয় ঢেউ নয়, নতুন ধরনের করোনা অধিকতর উদ্বিগ্ন করেছে।অতিক্রান্ত বছরের বিচ্ছেদ, বেদনা এবং সর্বোপরি অনেক মৃত্যুতে আমরা সবাই ভারাক্রান্ত। তবুও শত বেদনা, দুঃখ-কষ্ট, গ্লানি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, শোক কাটিয়ে মানুষ এগিয়ে যায়। নতুন সূর্যের উদয়ে প্রতিটি জীবন দেখে নতুন স্বপ্ন।
নববর্ষ নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “ নববর্ষ সংগ্রাম করে আপন অধিকার লাভ করে; আবরণের আবরণকে ছিন্ন বিদীর্ণ করে তবে তার অভ্যুদয় ঘটে।’ এবার হয়তো তাই ঘটবে এবং ঘটেছেও!
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়নো বাংলাদেশ যে দুর্যোগে দুঃসময়ে তার আত্মশক্তির বলে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তা সে আবার প্রমাণ করল। সম্প্রতি ৫৩টি দেশের করোনা মহামারি মোকাবিলার সক্ষমতা পরিমাপ করে ব্লুমবার্গ যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশ চার ধাপ এগিয়ে শীর্ষ ২০-এ স্থান করে নিয়েছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের পেছনে পড়ে গেছে অনেক উন্নত দেশ। তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশে কোনো সংকট নেই। নিশ্চয়ই কম আয়ের মানুষ কষ্টে আছেন।
২০২০ সালেই আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এক নয়া উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারতাম। উল্লেখ্য, মহামারির আগে আগে আমরা দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য যথাক্রমে ২০ শতাংশ ও ১০ শতাংশের কাছাকাছি নামিয়ে এনেছিলাম। দুই অঙ্কের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চলে এসেছিল হাতের নাগালে।
আমাদের স্বপ্নের অভিযাত্রায় একটা ছেদ পড়েছে- এ কথা মেনে নিয়েও বলতে হবে মহামারিজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থা মোকাবিলায় আমরা বেশ ভালোই করেছি। ২০২০ সালের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো সে কথাই বলছে। ২০১৯ সালের জুনে আমাদের রিজার্ভ ছিল ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
এদিকে ২০২০ সালে শিক্ষা খাতও এলোমেলো হয়ে গেছে। করোনা সংক্রমণের হার লাগামের মধ্যে না আসায় দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে, শ্রেণিকক্ষের পঠন-পাঠন মূল্যায়ন থমকে গেছে।
শহরের পাশাপাশি মফস্বল এলাকার অনেক ইংরেজি মাধ্যম এবং কিন্ডারগার্টেন স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে অগণিত শিক্ষক চাকরি হারিয়ে শ্রমজীবী মানুষের খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য হয়েছেন। শিক্ষা খাতের এসব সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের আন্তরিকতার কমতি ছিল না। তদুপরি রেডিও, সংসদ টিভি ও মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হলেও বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী সবকিছুর বাইরে থেকে গেছে। সব স্তরের শিক্ষার্থীদের এসব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। বেসরকারিভাবে পরিচালিত গবেষণায় শিক্ষা খাতের আরও কিছু বিপর্যয়ের আশঙ্কা উঠে এসেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক বিষয় যেমন- ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার, বাল্যবিয়ে, শিশুশ্রম এবং অপুষ্টির হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আগামীতে পরীক্ষামূলকভাবে হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া এবং শিক্ষকদের কথা ভেবে হলেও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে সীমিত পরিসরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়টি নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখবেন বলে আশা করি।
আত্মতুষ্টি থেকে নয়, আত্মবিশ্বাসের জায়গা থেকেই বলতে পারি, বাংলাদেশ কঠিন সময় মোকাবিলা করতে জানে, ঘুরে দাঁড়াতে জানে। ২০২০ সালে করোনার মধ্যেই আমরা সফলভাবে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ এবং দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা মোকাবিলা করেছি। করোনাকালেও আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। নিজেদের অর্থায়নে আমরা পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ প্রায় শেষ করে এনে বিশ্বকে দেখিয়েছি, আমরাও পারি। এর আগেও আমরা কঠিন প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় পার করেছি।
অতিমারির স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের ২০২১ সালে পথ চলতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, নতুন বছরে বাংলাদেশে আর্থসামাজিক পুনরুত্থান ঘটবে। সবাই নীরোগ ও নিরাপদ থাকবেন। স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে একটি মানবিক অধিকারসম্পন্ন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে এগিয়ে যাব সবাই মিলে।
Discussion about this post