বিশেষ প্রতিবেদক
করোনা সংকটেও এবার বছরের শুরুতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দিয়েছে সরকার। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্টদের অবহেলার কারণে সরকারের মহৎ উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে প্রকাশিত এসব বই ভুলে ভরা। রাষ্ট্র, সংবিধান, সরকার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে এসব বইয়ে বিভ্রান্তিকর সব তথ্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
তথ্যমতে, বাংলাদেশের সংবিধানে এ পর্যন্ত ১৭টি সংশোধনী আনা হলেও নবম-দশম শ্রেণির পৌরনীতি ও নাগরিকতা বইয়ের সংবিধান অধ্যায়ে ৫১ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ‘১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের পর থেকে এ পর্যন্ত সংবিধান মোট ১৬ বার সংশোধন করা হয়েছে’। অথচ ২০১৮ সালের এপ্রিলে সপ্তদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়। এরপর তিন বছর পার হতে চললেও এটি সংশোধন করেনি এনসিটিবি।
‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন’ অধ্যায়ে ৭৫ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- ‘একটি দল নির্বাচিত হয়ে সঠিকভাবে জনগণের জন্য কাজ না করলে পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ সাধারণত সেই দলকে আর নির্বাচিত করে না। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের এটি যেমন সত্যি তেমনিভাবে অনুন্নত দেশের ক্ষেত্রেও সত্যি। তেমনি, বাংলাদেশে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপিকে এবং ২০০৮ সালে বিএনপির পরিবর্তে আওয়ামী লীগকে এ দেশের জনগণ ক্ষমতায় বসায়’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাঠ্যবইয়ে এটি লেখার মাধ্যমে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের কাছে আওয়ামী লীগের শাসনামলকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। একইভাবে সরকারকেও বিব্রত করা হয়েছে চরমভাবে।
বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা অধ্যায়ে ৫৬ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- ‘দেশের প্রকৃত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের হাতে ন্যস্ত। মন্ত্রিপরিষদই প্রকৃত শাসন ক্ষমতার অধিকারী’। অথচ সংবিধানের ৫৫ (২) অনুযায়ী- ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাহার কর্তৃত্বে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে।’
৫৭ নং পৃষ্ঠায় রাষ্ট্রপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- ‘কোন ব্যক্তি পর পর দুই মেয়াদ অর্থাৎ একটানা ১০ বছরের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে থাকতে পারেন না’। অথচ সংবিধানের ৫০ (২) অনুযায়ী- ‘একাদিক্রমে হউক বা না হউক- দুই মেয়াদের অধিক রাষ্ট্রপতির পদে কোন ব্যক্তি অধিষ্ঠিত থাকিবেন না।’ বইটির এ অধ্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও রাষ্ট্রপতি নিয়ে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, দেশে মোট ১১টি সংসদ নির্বাচন হলেও ৭৫ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে দেশে ১০ বার সংসদ নির্বাচন হয়েছে। ৮৩ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- ‘জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জেলার জনগণ দ্বারা সরাসরি নির্বাচনের বিধান রাখা হয়। অথচ জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ অনুযায়ী- ‘প্রত্যেক জেলার অন্তর্ভুক্ত সিটি করপোরেশন যদি থাকে তাহলে মেয়র ও কাউন্সিলরগণ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র ও কাউন্সিলর এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সমন্বয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচকমন্ডলী গঠিত হবে।’
সরকার শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে নিরুৎসাহিত করলেও পাঠ্যবইয়ে কোচিংকে শিক্ষার বাড়তি ‘সুযোগ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বইটির ১১১ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- ‘মীনার বড় ভাই বিভিন্ন ক্লাসে শিক্ষকদের কাছে কোচিং করলেও তাকে কখনো এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়নি’। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, পাঠ্যবইয়ে এমন পাঠ সংযোজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে আগ্রহের অপচেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠন অধ্যায়ে ১৩৭ নং পৃষ্ঠায় জাতিসংঘ সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘শুরুতে জাতিসংঘের সদস্য সংখ্যা ছিল ৫০’। অথচ প্রতিষ্ঠাকালীনই জাতিসংঘের সদস্য ছিল ৫১টি দেশ।
বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। কিন্তু নবম-দশম শ্রেণির বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা বইয়ের ১৮৮ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ‘সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন’। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, জাতীয় এ নেতাকে ভুলভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভুল ইতিহাস শেখানো হচ্ছে।
ডা. শামসুল আলম খান মিলন তৎকালীন স্বৈরাচার সরকারের সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হলেও বইয়ের ২১৯ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পাশে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন’।
নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ বইয়ে বাংলাদেশের উৎসবের বিবরণে ২১ ফেব্রুয়ারি ও মহররমকে উৎসব হিসেবে দেখানো হয়েছে। অথচ ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং মহররমের ১০ তারিখে আশুরা, যা শোক হিসেবে পালিত হয়।
এছাড়া বইটির ১২৭ নং পৃষ্ঠায় বৈশাখী মেলার বিবরণ দেওয়া হলেও পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলে দেশের বৃহৎ আয়োজনের কথা উল্লেখ করা হয়নি। পাঠ্যবইগুলোতে অনেক বানান ভুল লক্ষ্য করা গেছে।
অষ্টম শ্রেণির সাহিত্য কণিকা বইয়ের ২৭ নং পৃষ্ঠায় ‘বিব্রত’ শব্দের শব্দার্থ হিসেবে লেখা হয়েছে ব্যাকুল, ব্যতিব্যস্ত। নবম-দশম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য বইয়ে ‘রহমানের মা’ অধ্যায়ে লেখকের পরিচয়ে বলা হয়েছে- রণেশ দাশগুপ্ত ঢাকার লৌহজংয়ের গাউপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জানা গেছে, এ লেখক ভারতের আসামে জন্মগ্রহণ করেন।
বইটির ‘পোস্টার’ অধ্যায়ে লেখকের পরিচয়ে বলা হয়েছে- আবুল হোসেন খুলনা জেলার ফকিরহাট থানায় জন্মগ্রহণ করেন। কার্যত, ফকিরহাট থানা বর্তমানে বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত। ফকিরহাট একসময় খুলনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই হিসাবে লেখার ক্ষেত্রে ‘তৎকালীন’ শব্দটি ব্যবহার করা উচিত ছিল। বইটিতে তা উল্লেখ করা হয়নি।
দুই শ্রেণির দুটি বইয়ে একই লেখকের পরিচিতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও ভিন্ন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ে ‘অবাক জলপান’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে ‘সুকুমার রায় ১৯২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।’ অথচ নবম-দশম শ্রেণির ‘ছায়াবাজি’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে- এ লেখকের মৃত্যু হয় ১৯২৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। এনসিটিবি প্রণীত একই লেখকের ভিন্ন ভিন্ন তথ্যে বিভ্রান্ত শিক্ষার্থীসহ শিক্ষকরাও।
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ২০১৩ সালে এসব বই প্রণয়ন করা হয়েছে। ভুল হয়ে থাকলে এসব বইয়ের লেখক, সম্পাদনা পরিষদ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসব আমরা।
তিনি আরও বলেন, লেখকরা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এসব লিখেছেন সে ব্যাপারে বাখ্যা চাওয়া হবে। যাচাই করে ভুল পাওয়া গেলে অবশ্যই সংশোধন করা হবে।
Discussion about this post