ঘরবাড়ি, সহায়-সম্বল বিক্রি করে ভাগ্যের অন্বেষণে বিদেশে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে অনেকে। চাকরি না পেয়ে অনেকে ফিরে আসছে খালি হাতে। মধ্যপ্রাচ্যের মন্দায় অনেকে ছাঁটাই হয়ে ফিরছে দেশে। কেউ আবার প্রবাসে গিয়ে কর্মস্থলে কিংবা তার বাইরে দুর্ঘটনায় অঙ্গ হারিয়ে ফিরছে পঙ্গু হয়ে। এভাবে ফেরত আসা শ্রমিকদের জীবনের বাকি অংশ পরিজনদের নিয়ে কাটে দুঃসহ যন্ত্রণায়। তাদের এই দৈন্যদশা থেকে কিছুটা রেহাই দিতে বিদেশগামী কর্মীদের বীমার আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রবাসে আহত-নিহত হলে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বীমা সুবিধা পাবে তারা। বিদেশে গিয়ে কাজে নিয়োগ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে স্থায়ী চাকরিচ্যুতি হলে পাবে চার লাখ টাকা। এর বাইরে প্রবাসে চাকরি হারিয়ে কেউ বেকার হলে তাকে সর্বোচ্চ তিন মাস ২৫ হাজার টাকা করে ৭৫ হাজার টাকা বেকার ভাতা দেওয়ার কথাও বলা আছে খসড়া নীতিমালায়।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) বিদেশগামী কর্মীদের বীমার আওতায় আনার এই খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। খসড়াটি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর মন্ত্রণালয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অনুমোদন করেছে।
আইডিআরএর সদস্য গকুল চাঁদ দাস কালের কণ্ঠকে বলেন, “প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া খসড়াটি বীমাসংক্রান্ত সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটি ‘সেন্ট্রাল রেটিং কমিটি’র আগামী বৈঠকে উত্থাপন করা হবে। সেখানে অনুমোদন পাওয়ার পর বীমা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন শেষে ‘প্রবাসী কর্মী বীমা নীতিমালা’ নামে এটি কার্যকর করা হবে। এই নীতিমালার আওতায় প্রবাসীদের জীবন বীমা এবং চাকরি হারানো, বাফার টাইম, লে-অফ বা কম্পানি বন্ধের কারণে বীমা সুবিধা থাকবে। শুরুতে প্রবাসে থাকা বাংলাদেশিরা এই বীমা সুবিধা পাবে। পরে প্রবাসে যেতে আগ্রহীরাও এর আওতায় আসবে।
মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন করা খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, প্রবাসে কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হলে পাঁচ লাখ টাকা বীমা সুবিধা পাবে। বীমাগ্রহীতাদের বয়স-নির্বিশেষে সবার জন্য অভিন্ন প্রিমিয়াম হার থাকবে। বীমা চলাকালীন বীমাকারী মারা গেলে তার উত্তরাধিকার বীমা অঙ্কের শতভাগ বা পাঁচ লাখ টাকা পাবে। প্রবাসে দুর্ঘটনায় কেউ উভয় চোখের দৃষ্টিশক্তি হারালে মূল বীমা অঙ্কের শতভাগ বা পাঁচ লাখ টাকা পাবে। কবজির ওপর থেকে উভয় হাত কাটা বা
খোয়া গেলে বা হাঁটুর ওপর থেকে উভয় পা কাটা বা খোয়া গেলেও পাঁচ লাখ টাকা পাবে। এ ছাড়া দুর্ঘটনায় কবজির ওপর থেকে এক হাত এবং হাঁটুর ওপর হতে এক পা কাটা বা খোয়া গেলে পাঁচ লাখ টাকা, কবজির ওপর থেকে এক হাত এবং এক চোখের দৃষ্টিশক্তি চিরতরে হারালে পাঁচ লাখ টাকা পাবে। এ ছাড়া হাঁটুর ওপর থেকে এক পা এবং এক চোখ চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারালেও একই পরিমাণ অর্থ পাওয়া যাবে।
দুর্ঘটনায় স্থায়ী ও আংশিক অক্ষমতার কারণেও বীমা সুবিধা পাবে প্রবাসীরা। এ ক্ষেত্রে এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারালে মূল বীমার ৫০ শতাংশ বা আড়াই লাখ টাকা পাবে। উভয় কানের শ্রবণশক্তি হারালে ৪০ শতাংশ বা দুই লাখ টাকা, এক কানের শ্রবণশক্তি হারালে এক লাখ টাকা পাবে। এ ছাড়া নিচের চোয়াল সরে গেলে সোয়া লাখ টাকা, হিউমেরাস কনুই থেকে স্কন্ধ সন্ধি পর্যন্ত হাড়ের উল্লেখযোগ্য অংশ ক্ষয় হলে (যার কোনো চিকিৎসা নেই) সোয়া লাখ টাকা, বৃদ্ধাঙ্গুলসহ হাতের চার আঙুল সম্পূর্ণভাবে কেটে গেলে দুই লাখ টাকা, শুধু বৃদ্ধাঙ্গুল সম্পূর্ণ কেটে গেলে সোয়া লাখ টাকা। শুধু তর্জনী আঙুল সম্পূর্ণভাবে কেটে গেলে মূল বীমা পাঁচ লাখের ১৫ শতাংশ, শুধু মাঝের আঙুল বা শুধু অনামিকা আঙুল সম্পূর্ণ কাটা গেলে ১০ শতাংশ, শুধু ছোট আঙুল সম্পূর্ণ কাটা গেলে ৭ শতাংশ, ঊরুসন্ধির অনমনীয় অবস্থা হলে মূল বীমা অঙ্কের ২০ শতাংশ, পায়ের বড় আঙুলসহ চার আঙুল সম্পূর্ণ কাটা গেলে মূল বীমার ২৫ শতাংশ এবং পায়ের বড় আঙুল সম্পূর্ণ কাটা গেলে মূল বীমা অঙ্কের ১০ শতাংশ পাবে প্রবাসীরা।
চাকরি হারানো, বাফার টাইম, লে-অফ বা কম্পানি বন্ধের জন্য বীমা সুবিধা সম্পর্কে খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, বীমার মেয়াদ হবে দুই বছর। তবে চাকরি থাকা সাপেক্ষে আরো দুই বছর বাড়ানো যাবে। ১৮ থেকে ৫৮ বছর পর্যন্ত যে কেউ এ বীমা করতে পারবে। কোনো বীমাগ্রহীতা কাজে নিয়োগ পাওয়ার পর তিন মাসের মধ্যে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত হলে মূল বীমার ৮০ শতাংশ বা চার লাখ টাকা, তিন মাস থেকে ছয় মাসের মধ্যে চাকরিচ্যুতি হলে ৭০ শতাংশ, ছয় মাস থেকে ৯ মাসের মধ্যে চাকরিচ্যুতি হলে ৬০ শতাংশ, ৯ থেকে ১২ মাসের মধ্যে চাকরিচ্যুতি হলে ৫০ শতাংশ, ১২ মাস থেকে ১৫ মাসের মধ্যে চাকরিচ্যুতি হলে ৪০ শতাংশ, ১৫ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে চাকরিচ্যুতি হলে ৩০ শতাংশ এবং ১৮ থেকে ২৪ মাসের মধ্যে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুতি হলে ২০ শতাংশ বীমা সুবিধা পাবে।
তবে নিয়োগকারীর অসদাচরণ বা অনৈতিক ব্যবহার, শ্রমিক অসন্তোষের জন্য কারখানা বন্ধ করে দেওয়া, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের জোরপূর্বক চাকরিচ্যুতি, নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে এবং কম্পানি দেউলিয়া বা অবসায়ন হওয়ার কারণে চাকরিচ্যুত প্রবাসীরা এই সুবিধা পাবে। কোনো প্রবাসী নিজ ইচ্ছায় চাকরি ছাড়লে বা নিজের অসদাচরণ বা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে চাকরি গেলে বীমা সুবিধা পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া অদক্ষতার কারণে, অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়ার কারণে কিংবা নিয়োগকর্তার কাছে মিথ্যা ঘোষণায় চাকরি নেওয়ার পর ছাঁটাই হলে বীমা সুবিধা পাওয়া যাবে না।
Discussion about this post