তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারটি শ্রেণিতে আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা তুলে দিয়ে চালু হচ্ছে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। আচার-আচরণ, সারা বছর ক্লাসে পর্যবেক্ষণ, সাপ্তাহিক ও মাসিক পরীক্ষাসহ বিভিন্নভাবে মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিবিড় তদারকিতে রাখা হবে। শিশুর শোনা, বলা, পড়া ও লেখার যোগ্যতা ও দক্ষতা নিরূপণ করে এর ভিত্তিতে পরবর্তী শ্রেণিতে পদোন্নতি দেয়া হবে। কয়েকদিনের মধ্যে দেশের ১০০টি নির্বাচিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই পদ্ধতি পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হবে। আগামী বছর দেশের সরকারি-বেসরকারিসহ সব ধরনের বিদ্যালয়ে এটি চালু হবে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম-আল-হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী শিশু থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত চারটি ক্লাস থেকেই আমরা আনুষ্ঠানিক বা সাময়িক পরীক্ষা তুলে দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের অধীনে এনে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। শিশুর লেখাপড়ার বাইরে ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিতি, পাঠে মনোযোগ, লেখাপড়ায় পারঙ্গমতা, পোশাক-পরিচ্ছদ, ব্যবহার ইত্যাদি বিবেচনায় নেয়া হবে। সারা বছর ধরে এসব বিষয়ে দেয়া নম্বরের আলোকেই পরবর্তী শ্রেণিতে পদোন্নতির উপযুক্ততা নির্ধারণ করা হবে। শিক্ষার্থীদের ফলাফলভিত্তিক কোনো রোল নম্বর থাকবে না। এর পরিবর্তে তাদের একটি পরিচিতি নম্বর দেয়া হবে। ধারাবাহিক মূল্যায়নে নম্বরের পরিবর্তে দেয়া হবে লেটার গ্রেড বা ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’ ইত্যাদি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়ায় প্রস্তুতি হিসেবে গোটা প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম নতুনরূপে তৈরি করতে হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের দিতে হচ্ছে প্রশিক্ষণ। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধীনে ১০০ স্কুলে পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের ট্রাইআউট (পরীক্ষা) শুরু হবে। দৈবচয়নভিত্তিতে নির্বাচিত ওইসব স্কুলে নেয়া হবে না কোনো পরীক্ষা। যেহেতু বিদ্যমান পাঠ্যপুস্তক দক্ষতা নিরূপণের উপযোগী করে লেখা, যা তিনটি সাময়িক পরীক্ষার মাধ্যমে শিখনফল যাচাই করা হয়; তাই এই পাঠ্যপুস্তকেই ধারাবাহিক মূল্যায়ন করতে এনসিটিবির বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ট্রাইআউট চলছে। এই ১০০ প্রতিষ্ঠানের প্রয়োগফলের ভিত্তিতে আগামী বছর দেশের সব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োগ করা হবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। তবে চতুর্থ শ্রেণি থেকে যথারীতি তিনটি করে পরীক্ষা থাকবে। থাকবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, এখন পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই দেয়া হবে। তৃতীয় শ্রেণিতে আগের নিয়মেই দেয়া হবে কিনা সেটি অবশ্য এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। তবে সরকার যেহেতু তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই শেষপর্যন্ত ওই শ্রেণিতেও নতুন শিক্ষাক্রমের বই দেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
এদিকে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পাশাপাশি সরকার তথ্য সংগ্রহও করছে। আগামী মে মাসের মধ্যে বিদ্যালয়গুলো থেকে বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে। জুন মাসে সব তথ্য বিশ্লেষণ করা হবে। জুলাই মাসে এসব তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে এনসিটিবি। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষভিত্তিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শিখন টুলস পরিমার্জন করা হবে। এরপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে আগস্ট মাসে ৭ দিনব্যাপী মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। তারা ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর সারা দেশের শিক্ষকদের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রশিক্ষণ দেবেন। পরে (ডিসেম্বরে) শিক্ষকদের জন্য মূল্যায়ন নির্দেশিকা ছাপিয়ে সারা দেশে বিতরণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. একেএম রিয়াজুল হাসান বলেন, সামষ্টিক পরীক্ষা বাদ দিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নে শিক্ষকরাই গুরুত্বপূর্ণ। তারা প্রতিদিন পাঠদানের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কাজ দিয়ে শ্রেণিকক্ষে শিশুদের মূল্যায়ন করবেন। এতে পাঠের বিষয়বস্তু শিশু বুঝেছে কিনা সেটি নিরূপণ করা যাবে। সপ্তাহ শেষে শিক্ষার্থীর ‘শিখন যোগ্যতা’ মূল্যায়ন করে শিক্ষক তার ডায়েরিতে লিখে রাখবেন। প্রতি তিন মাস পর শিক্ষক প্রতিটি শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে একটি ‘গ্রেড’ বা ‘নম্বর’ দেবেন। এভাবে বছরে তিনটি মূল্যায়নের সমম্বয় করে শিশু পরবর্তী শ্রেণিতে পদোন্নতি পাবে।
তিনি আরও জানান, আগামী বছর নতুন বইয়ের সঙ্গে শিক্ষকদের জন্য একটি অ্যাপ তৈরির কাজ চলছে। তাতে শিক্ষার্থী ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্যাটাগরি ও ধাপ নির্ধারণ করে দেয়া হবে। শিক্ষকরা তা অনুসরণ করে শিশুদের মূল্যায়ন করবেন। এছাড়া শিক্ষকদের ম্যানুয়ালও দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, শিশুদের ওপর পরীক্ষার চাপ কমাতে গত বছরের ১৩ মার্চ এক অনুষ্ঠানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
Discussion about this post