কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে নেয়া প্রায় ১৮শ’ কোটি ব্যয়ের “স্কিলস অ্যান্ড ট্রেনিং এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট (স্টেপ)” শীর্ষক প্রকল্পে কেনাকাটার নামে বড় অঙ্কের অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। অনিয়ম তদন্তে ৩৮ কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে ১১টি কমিটি। অনুসন্ধান শেষে কমিটিগুলো প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে বলে জানা গেছে।
স্টেপ প্রকল্পের আওতায় দেশের ৩১টি জেলার পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটগুলোতে বিভিন্ন মালামাল ও যন্ত্রপাতি কেনা হয়। কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ উঠায় প্রকল্পভুক্ত ৩১ জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য কেনা যন্ত্রপাতি সম্পর্কে প্রতিবেদন দিতে ৩৮ কর্মকর্তার সমন্বয়ে ১১টি কমিটি গঠন করা হয়। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয় এসব কমিটিকে। এখনো পর্যন্ত কোনো কমিটি প্রতিবেদন দিতে পারেনি বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে একটি কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব বিল্লাল হোসেন বলেন, আমাকে ৫টি জেলার প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কোটি কোটি টাকার মালামাল কিনেছে। মালামালের মধ্যে অনেক ছোট ছোট যন্ত্রপাতিও আছে। কোনোরকম ঘুরে প্রতিবেদন দেয়া ঠিক হবে না। তাই কাজ শেষ করতে একটু সময় লাগছে।
দেশের কারিগরি শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার, বিশ্বব্যাংক ও কানাডার যৌথ অর্থায়নে নেয়া এ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল এক হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। প্রকল্পের একটি অংশ ছিল সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিউটে এককালীন মঞ্জুরি প্রদান। প্রথমে একেকটি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ৯ কোটি টাকা করে মঞ্জুরি দেয়া হয়।
এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও প্রথমে কিছু প্রতিষ্ঠানকে নয় কোটি টাকা করে দেয়া হয়। কিন্তু পরের ধাপের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বরাদ্দ কমিয়ে তিন কোটি টাকা করে দেয়া হয়। এ টাকায় বিভাগভিত্তিক ল্যাবরেটরি স্থাপন, শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ একাধিক কাজ করার কথা; কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট স্টেপ প্রকল্পের একটি চক্রের যোগসাজশে নামমাত্র ল্যাবরেটরি স্থাপন করে টাকা ছাড় করে নিয়েছে।
আর যেসব প্রতিষ্ঠান এ চক্রের মাধ্যমে কাজ করেনি তাদের বিল আটকে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া যারা সমঝোতায় কেনাকাটা করতে চায়নি, তাদের বরাদ্দ ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। আবার রফা না হওয়ায় প্রথমে কোনো প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহের কাজ দেয়া হয়নি। রফা হওয়ার পর আগে অযোগ্য হলেও পরে একই কাগজপত্রে কাজ দেয়া হয়েছে। বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠানোর ক্ষেত্রেও আছে নানা অভিযোগ।
অভিযোগ উঠেছে- প্রকল্পের চক্রভুক্ত কর্মকর্তারা অনুদানপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দিষ্ট সরবরাহকারীর কাছ থেকে ল্যাবরেটরির মালামাল কিনতে বলে দিতেন। কথামতো কাজ না করলে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সব নিয়মকানুন মেনে মালামাল কিনলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিল আটকে দেয়া হতো।
আবার কোনো প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেটভুক্ত সরবরাহকারীর থেকে পণ্য নিতে রাজি হলে সেই প্রতিষ্ঠানের দরপত্রের ডকুমেন্টস তৈরি করে দিত সম্ভাব্য দরদাতা প্রতিষ্ঠান। ফলে এমন ক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্রেও সাধারণ দরদাতা কাজ পেত না। কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিবের কাছে এমন বেশকিছু অভিযোগ পড়েছে।
অপকর্ম সহজ করতে পরিবারের সদস্যদের দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় নামসর্বস্ব কোম্পানি। পাশাপাশি প্রকল্পভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহজে যোগাযোগের লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষা খাতের প্রভাবশালী একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারকে ওই কোম্পানিতে পরিচালক হিসেবে নেয়া হয়। এরপরই কাজের আড়ালে লুটপাটে মেতে ওঠেন চক্রের সদস্যরা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মুনশী শাহাবুদ্দীন আহমেদ বলেন, গত ডিসেম্বরে এ প্রকল্প শেষ হয়ে গেছে। তবে এখন পর্যন্ত পিসিআর (প্রকল্প সমাপনী প্রতিবেদন) পাইনি। এ কারণে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) দু’বার অন্যত্র বদলি হলেও তাকে ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বদলির আদেশের পর ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। তবে যদি প্রকল্পের কোনো কাজে কেউ অনিয়ম-দুর্নীতি করে থাকেন, তবে তার পার পাওয়ার সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্টরা যেখানেই থাকুন না কেন, আইনত প্রকল্পের কাজের ব্যাপারে তিনি বা তারা দায়বদ্ধ। দোষী চিহ্নিত হলে সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আসতে হবে।
Discussion about this post