গতকাল বেলা সাড়ে ১১টা। স্কুল আঙিনায় ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো হৈ-হুল্লোড় নেই। নেই শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। দূর থেকে মনে হবে সরকারি ছুটি চলছে। কিন্তু ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থী বেঞ্চে মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ আবার সহপাঠীর সঙ্গে দুষ্টুমি করছে। পাশের শ্রেণিকক্ষে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন প্রধান শিক্ষক। তিনি একাই পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ সামলাচ্ছেন। আরেক সহকারী শিক্ষিকা খালেদা পারভীন একসঙ্গে একাধিক ক্লাস নিতে নিতে হাঁপিয়ে উঠে বিশ্রাম নিচ্ছেন।
এক বছর ধরেই গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মনিরাম আমিনা সরকারি বিদ্যালয়ের প্রতিদিনের চিত্র এটি। শিক্ষক সংকটে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা লাটে উঠেছে। মাত্র দুজন শিক্ষক দিয়ে চলছে দেড় শ শিক্ষার্থীর পাঠদান। শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস নিতে হয় তাঁদের। কখনো একসঙ্গে দুই-তিনটা ক্লাস নেন তাঁরা। আবার কখনো সব ছাত্র-ছাত্রীকে এক ক্লাসে নিয়ে পড়াতে বাধ্য হন। এমন নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে পাঠদান চালিয়ে নিতে নিতে হাঁপিয়ে উঠেছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
এদিকে বিদ্যালয়ে করুণ দশা চলা শিক্ষার্থীদের অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন অভিভাবকরা। গত এক বছরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়। আবার নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চলে যায় তারা। শিক্ষক সংকটে পাঠদান ব্যাহতের বিষয়ে শিক্ষা কর্মকর্তাকে জানালেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ প্রধান শিক্ষকের।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিস্থাপন ছাড়াই বদলি বাণিজ্যের শিকার বিদ্যালয়টি। প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের জন্য উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে দায়ী করছেন তাঁরা।
অভিভাকদের অভিযোগ, নিয়মনীতি না মেনেই খেয়াল-খুশি মতো শিক্ষক বদলি করায় বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। আর্থিক সুবিধার জন্য কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যেক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ২০১৮ সালে বিদ্যালয় থেকে অবসরে যান সহকারী শিক্ষক আনিসুল হক। এরপর ২০১৯ সালের এপ্রিলে বিদ্যালয়টি থেকে প্রতিস্থাপন ছাড়াই দুজন সহকারী শিক্ষিকাকে বদলি করেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানে বদলি করা হলেও বিদ্যালয়টির জন্য কোনো শিক্ষক পদায়ন করা হয়নি।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের সহায়তায় রেজিস্টার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। শুরুতেই পাঁচজন শিক্ষক নিয়ে পাঠদান কার্যক্রম চালানো হয়। এরপর ২০০৩ সালে এমপিওভুক্ত হয়। পরে ২০১৩ সালে রেজিস্টার থেকে জাতীয়করণ করা হয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০১০ সাল থেকে বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল আড়াই শ জন। ফলাফল আর পাঠদানে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করার রেকর্ড প্রতিষ্ঠানটির। শুরু থেকে বিদ্যালয়টিতে পাঁচজন শিক্ষক থাকলেও বদলি বাণিজ্যের শিকার হয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৮ সালে বিদ্যালয় থেকে অবসরে যান সহকারী শিক্ষক আনিসুল হক। ২০১৯ সালের এপ্রিলে বিদ্যালয়টি থেকে প্রতিস্থাপন ছাড়াই সহকারী শিক্ষিকা চামেলী আক্তারকে পাশের মল্লিকজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করেন শিক্ষা কর্মকর্তা। এরপর ওই বছরের আগস্টে আরো একজন সহকারী শিক্ষিকা কামরুন্নাহার বেগমকে উত্তর রামভদ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। পাঁচজন শিক্ষককে স্কুল থেকে প্রতিস্থাপন ছাড়াই বদলি করা হলেও গত এক বছরে কোনো শিক্ষককে পদায়ন করা হয়নি। ফলে শিক্ষক সংকটের কারণে পাঠদান চালিয়ে যেতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এমন পরিস্থিতির কারণে বিদ্যালয়টি থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন অভিভাবকরা। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমতে কমতে এখন মাত্র ৪০ জনে নেমে এসেছে। সেই সংখ্যাও এখন কাগজে-কলমে।
এ ব্যাপারে সাইফুল নামের স্থানীয় এক অভিভাবক বলেন, ‘গত বছরে এখান থেকে দুজন শিক্ষককে বদলি করার পর আর নিয়মিত ক্লাস হয় না। আমাদের বড়লোকদের মতো সামর্থ্য নেই ভালো স্কুলে পড়ানোর। সে জন্য এখানেই বাচ্চাকে পড়াচ্ছি।’
মোসলেম নামের আরেক অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে এখান থেকে শিক্ষকদের সরিয়ে অন্য স্কুলে দেওয়া হয়েছে। স্কুলটা ধ্বংস করার জন্য উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দায়ী।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু তৈয়ব বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয় থেকে নিয়ম না মেনেই শিক্ষক বদলি করা হয়েছে। প্রতিস্থাপন সাপেক্ষে শিক্ষক বদলির নিয়ম। কিন্তু সেই নিয়ম না মেনেই বদলি করা হয়েছে। আজ আমাদের স্কুল শিক্ষক সংকটে ভুগছে। বিষয়টি বারবার শিক্ষা অফিসে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
এ বিষয়ে জানতে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এ কে এম হারুন-উর-রশিদের মুঠোফোনে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে দ্রুত সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হোসেন আলী বলেন, ‘প্রতিস্থাপন ছাড়া শিক্ষক বদলির নিয়ম নেই।’
Discussion about this post