সুনির্দিষ্ট কোনো চাকরি নেই। নেই ব্যবসা-বাণিজ্য। অথচ ৩৩টি ব্যাংক হিসাব খুলে করেছেন কোটি কোটি টাকা লেনদেন। নামে-বেনামে গড়েছেন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পাহাড়। একজনের কামানো টাকায় পরিবারের সবাই এখন বিপুল ধন-সম্পদের মালিক।
সারা দেশে নেটওয়ার্ক গড়ে বছরের-পর-বছর প্রশ্নপত্র বিক্রি করে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এই সিন্ডিকেটের ১৪ সদস্যের অবৈধ আয়লব্ধ অর্থে গড়া শতকোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সন্দেহভাজন আরও ১০ জনের ব্যাংক হিসাব ও সম্পদের তথ্য চেয়ে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে জড়িতদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। সিআইডির প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সিআইডির অনুসন্ধান চলছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মেডিকেল, ডেন্টাল ও আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ভর্তিচ্ছুদের কাছে তা চড়া দামে বিক্রি করে আসছিল একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
এই সিন্ডিকেটের প্রধান মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু। তার আপন খালাতো ভাই আব্দুস সালাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যুরোর প্রিন্টিং প্রেসের মেশিনম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এই প্রেসেই ছাপা হতো মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। সেই সুযোগেই সালামের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বের করে ভর্তিচ্ছুদের কাছে বিক্রির নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন মুন্নু।
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর গত বছরের ২৪ আগস্ট মুন্নুসহ ১৪ জনকে গ্রেফতার করে মামলা করা হয়। এই মামলায় মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি তদন্ত করছে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ যাদের বিরুদ্ধে পাওয়া যাবে, তাদের আসামি করেই মামলা করা হবে এবং মানি লন্ডারিং আইনে যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা আছে, তা কার্যকর করা হবে।
প্রসঙ্গত, মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধলব্ধ আয় দিয়ে গড়ে তোলা স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদ আদালতের মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত করার বিধান রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রে জড়িত অন্তত ১০ জনের সম্পদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে তদন্ত সংস্থা সিআইডি। এর মধ্যে প্রশ্নফাঁস চক্রের হোতা জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নুর ৩৩টি অ্যাকাউন্টে লেনদেন ও তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের খতিয়ান, মুন্নুর স্ত্রী শারমিন আরা জেসমিন শিল্পীর ১৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন, তার নামে গড়ে তোলা সম্পদ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের চাঞ্চল্যকর তথ্য এখন তদন্ত সংস্থার হাতে।
এর বাইরেও এই চক্রের আরেক সদস্য ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধানের ৩৯টি ব্যাংক হিসাবে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তার সম্পদ ও এফডিআরের তথ্যও মিলেছে। এ ছাড়াও চক্রের সদস্য আব্দুস সালাম খানের দুটি, এমএইচ পারভেজ খানের ৫টি, জাকির হাসানের ৮টি, আলমাস হোসেন শেখের দুটি ও মোহাম্মদ আলমগীর হোসেনের দুটি ব্যাংক হিসাবের লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হতে মুন্নুসহ ছয়জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে সিআইডি। গত ১৩ এপ্রিল তাদের আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন জানালে আদালত প্রত্যেকের দুদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তবে এখনো তাদের সিআইডি হেফাজতে নেওয়া হয়নি। তারা সবাই কারাগারে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মাধবী রাণী পাল যুগান্তরকে বলেন, তদন্তে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। প্রশ্ন ফাঁস করে চক্রের সদস্যরা এত ধন-সম্পদের মালিক হতে পারে, তা বিস্ময়কর। প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। এ জন্য ছয়জনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, চক্রের প্রধান হোতা মুন্নুর ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২০০৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২১ কোটি ২৭ লাখ পাঁচ হাজার টাকা লেনদেনের সন্ধান মিলেছে। অথচ মুন্নুর কোনো নির্ধারিত চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তিচ্ছুদের কাছে প্রশ্ন বিক্রি করেই এ টাকার মালিক হয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
আর ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরেও অপরাধলব্ধ আয় দিয়ে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন মুন্নু। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১৬ একর জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। যার দলিলমূল্য চার কোটি পাঁচ লাখ ১৩ হাজার টাকা। এসব জমির প্রকৃত দাম দলিলমূল্যের চেয়ে ৩-৪ গুণ বেশি। এ ছাড়াও মুন্নুর মা জহুরা ভূঁইয়ার নামে ৮টি দলিলে প্রায় দুই একরের বেশি জমির সন্ধান মিলেছে।
যার দলিলমূল্য এক কোটি ৭৭ লাখ ৬৯ হাজার ৮০০ টাকা। অপরাধলব্ধ আয় লুকানোর জন্য মায়ের নামে তিনি এ জমি কিনেছেন বলে জানতে পেরেছে সিআইডি। এ ছাড়াও মুন্নুর দুই ছেলে ও দুই মেয়ের নামে ৪৪১ দশমিক ৬২ শতাংশ বা প্রায় পাঁচ একর জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও মিরপুরের শাহ আলী থানা এলাকায় মুন্নুর নামে ৫ তলা ও ৩ তলাবিশিষ্ট দুটি বাড়ি, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় ১৩ দশমিক ১ কাঠা আয়তনের ৩টি প্লট আছে।
যার দলিলমূল্য ৯০ লাখ ৬২ হাজার টাকা। মিরপুরে থাকা আরেকটি ফ্ল্যাটের দলিলমূল্য ৪০ লাখ টাকা। এ ছাড়া মুন্নুর নামে-বেনামে দুই কোটি ২৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পাওয়া গেছে। মুন্নুর গড়ে তোলা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান শাম্মী ফ্যাশনের নামে সাউথইস্ট ব্যাংকের রূপনগর শাখায় (হিসাব নম্বর: ০০৭৪১১১০০০০০৫৩৫) ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তিন কোটি ২৯ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা জমা করার পর একই সময়ে প্রায় সমপরিমাণ টাকা তুলে নেন।
একই প্রতিষ্ঠানের নামে সিটি ব্যাংক মিরপুর শাখায় (হিসাব নম্বর : ১৪০১৬২৯৯৮৫০০১) ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই পর্যন্ত দুই কোটি ৫৫ লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৫ টাকা জমা করেন এবং দুই কোটি ৫১ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। অথচ শাম্মী ফ্যাশনের তেমন কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। অপরাধলব্ধ আয় আড়াল করতেই তিনি এই প্রতিষ্ঠান খুলে লেনদেন করেন বলে জানতে পেরেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। আর মুন্নুর স্ত্রী শারমিন আরা জেসমিন শিল্পীর নামে বিভিন্ন ব্যাংকের ১৩টি অ্যাকাউন্টে দুই কোটি ৮৮ লাখ ১৪ হাজার ৪৪৭ টাকা জমা করেন। শারমিনের নামে সিংগাইর এলাকায় ৬টি জমিও আছে। যার পরিমাণ ২৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যার মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস করতেন মুন্নু, সেই আব্দুস সালামও প্রেসের সামান্য একজন মেশিনম্যান হয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। মানিকগঞ্জ জেলা রেজিস্ট্রার অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সিংগাইরের বিভিন্ন এলাকায় আব্দুস সালামের নামে ১০টি ও মানিকগঞ্জ সদরে ১টিসহ মোট ১১টি জমি আছে। যার পরিমাণ ৩৪০ দশমিক ২৫ শতাংশ বা প্রায় সাড়ে তিন একর। এসব জমির দলিলমূল্য দুই কোটি ৬১ লাখ ১৮ হাজার টাকা। এ ছাড়া স্ত্রী নাসরিন আক্তারের নামে ১২ দশমিক ৬৮ শতাংশ জমি আছে। যার দলিলমূল্য তিন লাখ ৯০ হাজার টাকা। সম্পদ গড়ার ক্ষেত্রে মুন্নুর বোন শাহজাদী আক্তার মীরাও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, মীরার নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ৪টি অ্যাকাউন্ট ও এফডিআর রয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে বিভিন্ন সময় এক কোটি ৭০ লাখ ৫৪ হাজার ৭৭৭ টাকা জমা করে অন্যত্র স্থানান্তর করেন। মীরার নামে উত্তরা ব্যাংক দারুসসালাম শাখায় (হিসাব নম্বর: ১৫২৯১১১০১১১২৫১৪) ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক কোটি ৩১ লাখ ৬১ হাজার ৪৩৭ টাকা জমা করে তা অন্যত্র স্থানান্তর করেন।
চক্রের আরেক সদস্য ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধানের নামে ৩৯টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৯ কোটি ১৩ লাখ ৪১ হাজার ৫৮৯ টাকা জমার পর তা উত্তোলন করেন। রাজাবাজার এলাকায় তার রয়েছে একটি বাড়ি। ময়েজ উদ্দিনের নামে ঢাকা ব্যাংক ধানমন্ডি শাখায় (হিসাব নম্বর: ২০৫২০০০০০০৪৯১৪৯) ২০০৮ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ছয় কোটি ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৯০৫ টাকা জমার পর প্রায় সমপরিমাণ টাকা উত্তোলন করে অন্যত্র স্থানান্তর করেন। ঢাকা ব্যাংকের একই শাখা (লোন হিসাব নম্বর: ২০৫১৭৪০০০০০১০১১) থেকে ১০ কোটি ২২ লাখ ৪৫ হাজার ৭৪৪ টাকা ঋণ তোলেন এবং নয় কোটি ২২ লাখ সাত হাজার ৩৬২ টাকা পরিশোধ করেন।
তদন্ত সূত্র জানায়, মুন্নু ও তার সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সূত্র ধরে আরও ১০ জনের ব্যাংক লেনদেন ও সম্পদ সম্পর্কে তথ্য পেতে বিভিন্ন সংস্থার কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এদের সম্পর্কে মুন্নুর কাছ থেকে উদ্ধার করা ডায়েরিতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। এদের মধ্যে দুজন চিকিৎসক, একজন ব্যাংক কর্মকর্তা ও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এই চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে শহীদ মনসুর মেডিকেল কলেজের হিসাব কর্মকর্তা আব্দুল লতিফকে গত ২৫ মার্চ গ্রেফতার করেছে সিআইডি। এ ছাড়া মুন্নুর ভাই জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া, ইমরান তালুকদার ও সামিউল জাফর সিটুর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্যও নিচ্ছে তদন্ত সংস্থা। সৌজন্যে-যুগান্তর
Discussion about this post