শিক্ষার আলো ডেস্ক
কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তার কবিতায় শৈল্পিক সিদ্ধির পাশাপাশি রয়েছে বিষয়ভাবনার সুগভীর বৈচিত্র্য।
ব্যক্তির একান্ত মনোলোককে যেমন তিনি নৈর্ব্যক্তিক ব্যঞ্জনায় প্রতিভাসিত করেন তেমনি সময়-সমাজ-দেশ ও বিশ্বপরিস্থিতির অনায়াস উদ্ভাসন ঘটে তার পঙ্ক্তিঘরের অবয়বে আর অন্তর্গূঢ় অনুভাবনে।
সোমবার (২৪ মে) রাত ১১টায় এই কবি চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। এদেশের সংগ্রামশীল ইতিহাস ও মানুষ, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রগতির অভিযাত্রা-রেখা ভাস্বর তার প্রায় অর্ধশত কবিতা বইয়ে।
শুধু কবিতা নয়, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর গদ্য যেন তার কবিতারই সহোদরা, আবার তা স্বতন্ত্রও বটে। বিবরণমূলক গদ্যধারার বিপরীতে হৃদয়ী সংবেদনে বিচিত্র-বর্ণিল-ব্যতিক্রম তার প্রাবন্ধিক গদ্যগুচ্ছ; যা ধারণ করেছে বাংলা ও বিশ্বসাহিত্য-সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ। তার আখ্যানমূলক ও আত্মজৈবনিক রচনাও অনন্যতার দাবিদার।
এছাড়া অনুবাদ তার আর এক প্রিয় ভুবন যেখানে রুমী কিংবা রসুল হামজাতভকে আমরা বাংলায় পাই তার কারুকলমে। শিশুকিশোর সাহিত্যে হাবীবুল্লাহ সিরাজী স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। আধুনিকমনষ্ক নতুন প্রজন্মের বোধে বিশেষ প্রিয়তায় ধরা দেয় তার ছড়া, কবিতা এবং এ জাতীয় শিশুতোষ-কৈশোরক রচনা। সবমিলিয়ে বাংলা সাহিত্যে হাবীবুল্লাহ সিরাজী এক বিশিষ্ট নাম যার বিবিধ রচনা অনূদিত হয়েছে বহু বিদেশি ভাষায়।
কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী ৩১শে ডিসেম্বর ১৯৪৮ ফরিদপুর জেলার রসুলপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবুল হোসেন সিরাজী, মাতা জাহানারা বেগম। ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক (১৯৬৪), ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক (১৯৬৬), বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে প্রকৌশল-স্নাতক (১৯৭০) ডিগ্রি লাভ করেন।
তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আছে- দাও বৃক্ষ দাও দিন (১৯৭৫), মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি (১৯৭৭), মধ্যরাতে দুলে ওঠে গ্লাশ (১৯৮১), হাওয়া কলে জোড়া গাড়ি (১৯৮২), নোনা জলে বুনো সংসার (১৯৮৩), স্বপ্নহীনতার পক্ষে (১৯৮৩), আমার একজনই বন্ধু (১৯৮৭), পোশাক বদলের পালা (১৯৮৮), কৃষ্ণ কৃপাণ ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯০), সিংহদরজা (১৯৯০), ম্লান, ম্রিয়মান নয় (১৯৯২), বিপ্লব বসত করে ঘরে (১৯৯৯), ছিন্নভিন্ন অপরাহ্ন (১৯৯৯), সারিবদ্ধ জ্যোৎস্না (২০০০), সুগন্ধ ময়ূর লো (২০০০), মুখোমুখি (২০০১), হ্রী (২০০৫), কতো কাছে জলছত্র, কতোদূর চেরাপুঞ্জি (২০০৬), কাদামাখা পা (২০০৬), ভুলের কোনো শুদ্ধ বানান নেই (২০০৮), শূন্য, পূর্বে না উত্তরে (২০০৯), ইতিহাস বদমাশ হলে মানুষ বড়ো কষ্ট পায় (২০০৯), একা ও করুণা (২০১০), যমজ প্রণালী (২০১১), আমার জ্যামিতি (২০১২), পশ্চিমের গুপ্তচর (২০১২), মিথ্যে তুমি দশ পিঁপড়ে (২০১৪), কবিরাজ বিল্ডিংয়ের ছাদ (২০১৫), বডিমিস্ত্রি ফেসবুক (২০১৬), যে শ্রেষ্ঠ একা (২০১৬), জো (২০১৭), আমি জেনারেল (২০১৮), সুভাষিত (২০১৯), ঈহা (২০১৯) ইত্যাদি।
কবিতা সংকলনের মধ্যে- প্রেমের কবিতা (১৯৮৯), বেদনার চল্লিশ আঙুল (১৯৯০), জয় বাংলা বলো রে ভাই (২০০০), নির্বাচিত কবিতা (২০০১), তুচ্ছ (২০০৩), স্বনির্বাচিত প্রেমের কবিতা (২০০৪), কবিতাসমগ্র (২০১১), হাবীবুল্লাহ সিরাজীর প্রেমের কবিতা (২০১৬) উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া আখ্যান হিসেবে- কৃষ্ণপক্ষে অগ্নিকা- (১৯৭৩), পরাজয় (১৯৮৮), আয় রে আমার গোলাপজাম (২০১৭) এবং অনুবাদ কর্ম হিসেবে- মৌলানার মন : রুমীর কবিতা (২০১৩), রসুল হামজাতভের কবিতা (২০১৯) উল্লেখযোগ্য। রয়েছে আত্মজৈবনিক গ্রন্থ- আমার কুমার (২০১০)।
গদ্যগ্রন্থ ও শিশুসাহিত্যের মধ্যে রয়েছে- দ্বিতীয় পাঠ (২০১০), মিশ্রমিল (২০১২), গদ্যের গন্ধগোকুল (২০১৮), পায়ে উর্বর পলি (২০১৮); ইল্লিবিল্লি (১৯৮০), নাইপাই (১৯৮৪), রাজা হটপট (১৯৯৯), ফুঁ (২০০১), ফুড়–ৎ (২০০৪), মেঘভ্রমণ (২০০৯), রে রে (২০১০), ছয় লাইনের ভূত (২০১১), একে শূন্য (২০১৫), কানাকানি (২০১৩), ছড়াছড়ি (২০১৮), মিলটিল (২০১৯)।
তার সম্পাদিত সাহিত্যপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো (১৯৬৬-১৯৮০) আগুন আমার ভাই, শতদল, বনানী, কলকণ্ঠ, এবং স্বরগ্রাম।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী বাংলা ভাষায় অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় একুশে পদক (২০১৬), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১), যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৭), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯), বিষ্ণু দে পুরস্কার (২০০৭), রূপসী বাংলা পুরস্কার, ভারত (২০১০), কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার (২০১০), মহাদিগন্ত পুরস্কার, ভারত (২০১১), বঙ্গবন্ধু স্মারক পুরস্কার, ভারত (২০১৩), ফজল শাহাবুদ্দিন কবিতা পুরস্কার (২০১৬), সিটি-আনন্দ আলো পুরস্কার (২০১৭), আবিষ্কার পুরস্কার (২০১৭), জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (২০১৮), লেখিকা সংঘ পদক (২০১৮), আবু হাসান শাহীন স্মৃতি পুরস্কার (২০১৮), প্রথম আলো পুরস্কার, ভারত (২০১৯) ইত্যাদি বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা-সংবর্ধনায় ভূষিত হয়েছেন।
তিনি বাংলা একাডেমি এবং ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ার্সের একজন ছিলেন ফেলো। ২০০৭-২০১৫ মেয়াদে জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি এবং বর্তমানে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছিলেন। পেশাজীবনে ১৯৭২-২০১৮ পর্যন্ত দেশে এবং দেশের বাইরে কুয়েত, ইরাক ও মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।
সর্বশেষ কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করেন।
Discussion about this post