শিক্ষার আলো ডেস্ক
“আলোকিত মানুষ চাই” শ্লোগানকে সামনে রেখে যে মানুষটি আলোকিত মানুষ গড়ার ব্রত নিয়েছেন তাঁকে আমরা সবাই চিনি। আর তিনি আমাদের সবারই প্রিয় সায়ীদ স্যার— অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি বাংলাদেশের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন সমাজসংস্কারক। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মূলত শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক। তিনি ষাট দশকের একজন প্রতিশ্রুতিময় কবি হিসেবে পরিচিত।
সেই সময় সমালোচক এবং সাহিত্য সম্পাদক হিসেবেও তিনি অনবদ্য অবদান রেখেছিলেন। তিনি একজন সুবক্তাও বটে। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র— যা পরিচালিত হয় মূলত বই পড়া কর্মসূচীর মাধ্যমে। তিনি বাংলাদেশের হাজার হাজার স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করছেন।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৩৯ সালের ২৫ জুলাই কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানার অন্তর্গত কামারগাতি গ্রামে। তাঁর পিতা আযীমউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক।
২০০৪ সালে তিনি রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন। অ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে অবদানের জন্য ২০০৫ সালে পেয়েছেন একুশে পদক। ২০১২ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সমালোচক এবং সুবক্তা এই মহৎপ্রাণ মানুষটির ৮২তম জন্মদিন আজ।
আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ খুব অল্প বয়সে মাকে হারান। তিনি ছিলেন ভাইবোনদের মধ্যে তৃতীয়। আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদের জীবনে তার পিতার প্রভাব সুস্পষ্ট। অধ্যাপনা করেছেন তিনি তিরিশ বছর-১৯৬২ সাল থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত।
কেন তিনি শিক্ষক হয়েছিলেন- এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘শিক্ষক হিসাবে আব্বা ছিলেন খ্যাতিমান। ১৯৫০ সালে আমি যখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, আব্বা তখন পাবনা এডোয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষ। কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তার কথা উঠলে এমন সশ্রদ্ধ উদ্বেলতায় উপচে পড়ত যে মনে হত কোনো মানুষ নয়, কোনো দেবতা নিয়ে তারা কথা বলছে। একজন ভালো শিক্ষক ছাত্রদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ভালোবাসার যে কী দুর্লভ বেদিতে অধিষ্ঠিত থাকেন আব্বাকে দেখে তা টের পেতাম। একজন মানুষের এর চেয়ে বড় আর কী চাওয়ার থাকতে পারে। তখন থেকেই আমি ঠিক করেছিলাম এই পৃথিবীতে যদি কিছু হতেই হয় তবে তা হবে শিক্ষক হওয়া, আব্বার মতোন শিক্ষক।’
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’র একটি চমক হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। এই কার্যক্রমে বই-ভর্তি একটি বাস পাঠকের দুয়ারে গিয়ে হাজির হয়। ১৯৯৮ সালে এই ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি ঢাকায় শুরু হলেও আজ তা বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলায় বিস্তৃত হয়েছে।
শিক্ষকতা জীবনও খুবই বর্ণাঢ্য তার ।১৯৬১ সালে প্রথম শিক্ষকতায় যোগদান করেন মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে। তখন বয়স বাইশ। ওই সময়ে মুন্সীগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন তার বাবা আযীমউদ্দীন আহমদ। শিক্ষাবিদ ও নাট্যকার হিসাবে যিনি সেকালে দেশের সুধীমহলে সুপরিচিত । ছেলে একই কলেজে যোগ দিলে তার জন্য প্রশাসনিক অস্বস্তির কারণ হবে মনে করে তিনি কলেজের গভর্নিং বোর্ডের সভায় আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদকে অন্তর্ভূক্তি করার ব্যাপারে আপত্তি প্রকাশ করেন। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল ভাল থাকায় কলেজের গভর্নিং বডির সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে কলেজের খন্ডকালীন প্রভাষক হিসাবে তাকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। গভর্নিং বডির সচিব হিসাবে তার বাবাকেই তার নিয়োগপত্র পাঠাতে হয়েছিল। সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্তটি জমে উঠেছিল কলেজে তার যোগদানের প্রথম দিনটিতে।
সেই দিনের ঘটনা বর্ণনা করলেন তিনি এভাবে, ‘প্রথম ক্লাশে ছাত্রদের সঙ্গে নতুন শিক্ষকদের পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্ব অধ্যক্ষই পালন করতেন এটাই ছিল নিয়ম। আমার ব্যাপারেও আব্বাকেও তাই করতে হলো। রুটিন মাফিক আব্বার পেছনে পেছনে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির একটি শাখায় গিয়ে হাজির হলাম। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তার সংক্ষিপ্ত ইংরেজি ভাষণে আব্বা আমার একটা ছোটখাট পরিচয় তুলে ধরে সব শেষে বললেন, যেহেতু ওর শরীরে শিক্ষকের রক্ত আছে আমার মনে হয় ও ভাল শিক্ষকই হবে। আমার ধারণা ছিল, আমার নিয়োগের দ্বন্দ্বে পরাজয়ের ফলে উনি ভেতরে ভেতরে কিছুটা তেতে আছেন। হয়ত তার সেদিনের বক্তব্যে সেই ক্রোধের কিছু প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু ঘটনা হলো ঠিক উল্টো। বক্তৃতার সময় আব্বার গলা কিছুটা ধরেই এল। মনে হল তার উত্তরসূরির আসনে নিজ হাতে আমাকে বসিয়ে যেতে পেরে তিনি যেন ভেতরে ভেতরে গর্বিত এবং পরিতৃপ্ত।’
এরপর সিলেট মহিলা কলেজে যোগ দেন । সেই সময় মহিলা কলেজে ঢোকা তরুণ অধ্যাপকের জন্য সহজ ছিল না। কারণ তখন সিলেটের সমাজ খুবই রক্ষণশীল । এখানে তিনি বেশিদিন ছিলেন না।
এরপর রাজশাহী কলেজে। রাজশাহী কলেজের অত্যন্ত উঁচুমানের লাইব্রেরি তাকে খুবই আকৃষ্ট করেছিল । রাজশাহী কলেজে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি যোগ দেন ঢাকার ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে। একই সময় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগেও তিনি খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে বাংলা পড়িয়েছেন। ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন।
এর পর ঢাকা কলেজে। তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শত্তকত ওসমান।ঢাকা কলেজের শিক্ষকতা জীবন তিনি খুব উপভোগ করতেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু ঢাকা কলেজ ছেড়ে তিনি যাননি৷
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- উত্তর প্রজন্ম (২০০৮) সংগঠন ও বাঙালি (২০০৩) স্বর্ণদীপিতা (২০১০) রৌদ্র ও প্রকৃতির কাব্য (২০০৯) রোদরূপসী (২০০৬) স্বপ্নের সমান বড় (২০১২) স্বনির্বাচিত প্রবন্ধ ও রচনা (২০০০) ওড়াউড়ির দিনগুলো (২০০৯) অন্তরঙ্গ আলাপ (২০১২) নদী ও চাষীর গল্প (২০০৬) নিষ্ফলা মাটির কৃষক (২০০৬) নিউইয়ের্কর আড্ডা (২০০৭) মুখোমুখি (২০০৭) দুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০০৮) বন্ধ দরজায় ধাক্কা (২০০০) বহে জরবতী ধারা (২০০৬) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আমি (২০০৭) বিস্রস্ত জার্নাল (২০০৭) বিদায়, অবন্তী! (২০০৫) ভালোবাসার সাম্পান (২০০৭) আমার উপস্থাপক জীবন (২০০৮) আমার বোকা শৈশব (২০১০) আমার আশাবাদ (২০০৯)।
আজ এই মানুষ গড়ার কারিগরের জন্মদিনে শিক্ষার আলোর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
Discussion about this post